কৃষির যান্ত্রিকীকরণ করে কম খরচে উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা অর্জন করতে চায় সরকার। এ জন্য কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে নতুন অর্থবছরে ২৪ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
এটি প্রস্তাবিত বাজেট ব্যয়ের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে টাকার অঙ্কে এ খাতে বরাদ্দ বেড়েছে ২৬৬ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২৪ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা।
জাতীয় সংসদে বৃহস্পতিবার আগামী অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের সময় অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বোরো ধানের উৎপাদন বাড়াতে অতিরিক্ত প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো হাইব্রিড ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আউশ, আমন ও বোরো ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিগত বছরের তুলনায় এ বছর উৎপাদন বেশি হবে বলে প্রাক্কলন করা হচ্ছে।’
দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আগামী অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ২০ দশমিক ৫৫ লাখ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ সময় বৈশ্বিক মহামারি করোনা দুর্যোগে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ বাধার মুখে পড়ার আশঙ্কা থাকলেও সরকারের সময়োপযোগী সিদ্ধান্তে বাংলাদেশকে সংকটের মুখে পড়তে হয়নি বলে জানান মন্ত্রী।
তিনি বলেন, সরকারি পর্যায়ে খাদ্যশস্য সংরক্ষণের ধারণক্ষমতা ২৭ লাখ টনে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং রূপকল্প ২০২১ অনুযায়ী আধুনিক খাদ্যগুদাম বা সাইলো নির্মাণ করে সংরক্ষণক্ষমতা প্রায় ২২ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে বলেও জানান তিনি।
মন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমানে আরও প্রায় ৬ লাখ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার আধুনিক খাদ্যগুদাম বা সাইলো নির্মাণে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।’
খরচ কমিয়ে উৎপাদন বাড়াতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে বলেও জানান মন্ত্রী।
‘কৃষকদের কৃষিযন্ত্রের ক্রয়মূল্যের ওপর ৫০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত সহায়তার মাধ্যমে হ্রাসকৃত মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হচ্ছে। এর ফলে কৃষিশ্রমিকের অপ্রতুলতা পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে এবং উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পেয়েছে। এর আওতায় ২০১০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত প্রায় ৬৯ হাজার ৮৬৮টি কম্বাইন্ড হারভেস্টর, রিপার, সিডার, পাওয়ার টিলারসহ কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে।’
করোনাকালে হাওর এলাকার শ্রমিকসংকট মোকাবিলা করে কৃষিযন্ত্রের মাধ্যমে দ্রুত ফসল কেটে আগাম বন্যা থেকে ফসল রক্ষা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন মন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘খামার যান্ত্রিকীকরণ কার্যক্রম সম্প্রসারণের মাধ্যমে গ্রামীণ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং মূল্য শৃঙ্খলব্যবস্থার আধুনিকায়নের মাধ্যমে একটি আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হবে।’
নতুন প্রযুক্তি ও ফসলের জাত উদ্ভাবন করে উৎপাদন বাড়ানো ও বিপণনব্যবস্থা আধুনিকায়ন করে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও টেকসই আধুনিক কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলা সরকারের অন্যতম লক্ষ্য বলেও উল্লেখ করেন অর্থমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘কৃষির উন্নয়নে স্বাভাবিক ভর্তুকির অতিরিক্ত হিসেবে কৃষিজাতসামগ্রী রপ্তানির ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা ও কৃষিক্ষেত্রে বিদ্যুৎ-চালিত সেচযন্ত্রের ব্যবহারে বিদ্যুৎ বিলের ওপর ২০ শতাংশ রিবেট দেয়া হচ্ছে।’
কৃষি পুনর্বাসন সহায়তায় বিদায়ী অর্থবছরে ৪১৩ কোটি ৪৬ লাখ টাকার সার-বীজসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণ ২ কোটি ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৮৬৯ কৃষককে কার্ডের মাধ্যমে সরকার প্রণোদনা দিয়েছে বলেও জানান আ হ ম মুস্তফা কামাল।
সম্প্রতি কালবৈশাখীতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ১ লাখ বোরোচাষিকে এককালীন নগদ অর্থসহায়তা বাবদ ২৫ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে বলেও জানান অর্থমন্ত্রী।
পতিত জমির ব্যবহারের মাধ্যমে ফসলের আবাদ ও উৎপাদন বাড়াতে ৮০ হাজার হেক্টর অতিরিক্ত জমি চাষাবাদের আওতায় আনা হয়েছে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতি ইঞ্চি জায়গা চাষের আওতায় আনয়ন ও পারিবারিক পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ৩২টি করে সবজি-পুষ্টি বাগান সৃজন হচ্ছে। এতে ১ লাখ ৪১ হাজার ৭৯২ কৃষক ও তার পরিবার উপকৃত হবে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে বর্তমানে আমরা পরিবেশবান্ধব ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো উপযোগী কার্যক্রমের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। গবেষণার মাধ্যমে সহিষ্ণু প্রযুক্তি ও ফসলের জাত উদ্ভাবন এবং হস্তান্তরের কাজ চলছে।’
কীটনাশকমুক্ত শাকসবজি নিশ্চিত করতে কৃষি মন্ত্রণালয় ‘কৃষকের বাজার’ নামে একটি কর্মসূচি নিয়েছে বলেও জানান মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘সারা দেশে বর্তমানে ৪১টি জেলায় কৃষকের বাজার স্থাপন করা হয়েছে। ফলে কৃষকরা কৃষিপণ্যের উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছে।’
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ
দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে নতুন প্রযুক্তি ও জাত উদ্ভাবন, উদ্যোক্তা, খামারিদের উদ্বুদ্ধ করা, প্রশিক্ষণ, আত্মকর্মসংস্থান নিশ্চিতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ মাছ, মাংস ও ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে এবং দুধ উৎপাদনে অচিরেই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ খাত দেশের অভ্যন্তরীণ আমিষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য এবং প্রাণিজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।’
মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের সফলতা তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম এবং তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ ও এশিয়ার মধ্যে তৃতীয় স্থানে রয়েছে।’
মৎস্য খাতের উন্নয়নে নেয়া সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘খোলা জলাশয়ে মাছ চাষ, বিপন্নপ্রায় মৎস্য প্রজাতির সংরক্ষণ, মাছের প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির জন্য অভয়াশ্রম সৃষ্টি, জাটকা সংরক্ষণ, পরিবেশবান্ধব চিংড়ি চাষ অব্যাহত আছে।’
গ্রামীণ মাছচাষি, জেলে ও মৎস্যজীবীদের তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে দেশব্যাপী জেলে নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান এবং ডাটাবেজ তৈরির কাজ চলমান রয়েছে বলে জানান মুস্তফা কামাল।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মৎস্য খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় কমিউনিটি-বেইজড ক্লাইমেট রেজিল্যান্ট অ্যাকুয়াকালচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট ইন বাংলাদেশ নামের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে জানান মন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট নামের একটি প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। হালদা নদীকে “বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ” ঘোষণা করা হয়েছে।’