মহামারির মধ্যে থমকে থাকা অর্থনীতির চাকা পুরোপুরি সচল করার মতো পরিস্থিতি কবে হবে-সেই নিশ্চয়তা না থাকলেও প্রবৃদ্ধির বড় লক্ষ্য ধরে নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
তবে এবার গতবারের চেয়ে একটু কম উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য ধরেছেন অর্থমন্ত্রী। নতুন বাজেটে তিনি ৭ দশমিক ২ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) অর্জনের প্রত্যাশা করেছেন।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ছয় লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার এই বাজেট প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী, যা বাস্তবায়ন করতে গেলে তাকে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর কঠিন চ্যালেঞ্জ সামলাতে হবে, নির্ভর করতে হবে ঋণের উপর।
করোনাভাইরাস মহামারির আগপর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েই চলেছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ধারাবাহিক অগ্রগতির পথ ধরে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বাংলাদেশ, যা ছিল দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি।
গত এক দশকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। আর চার বছরে এই হার ছিল ৭ শতাংশের উপরে।
কিন্তু গত বছরের মার্চে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও তছনছ হয়ে যায়; পাল্টে যায় সব হিসাবনিকাশ। তারপরও বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে আগের বারের (২০১৯-২০) মতো ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির বড় লক্ষ্য ধরেছিলেন উচ্চাভিলাষী অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল।
করোনার ধাক্কায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ অর্জিত হবে বলে হিসাব দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস। ২০২০-২১ অর্থবছরে হয়েছে ৬ দশমিক ১ শতাংশ।
তবে, মহামারির কারণে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে। কোনো কোনো দেশে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ।
অর্থমন্ত্রী কামাল সংসদে যে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন, তাতে ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের মূল জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদনের আকার গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ৩৪ লাখ ৫৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা।
বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরের মূল বাজেটে জিডিপির এই আকার ধরা ছিল ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। কিন্তু কোভিডের কারণে সংশোধিত বাজেটে এই লক্ষ্য কমিয়ে ৩০ লfখ ৮৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে।
মহামারির কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য এবার কম ধরেছেন বলে বাজেট বক্তৃতায় স্পষ্ট করেছেন অর্থমন্ত্রী।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল বাংলাদেশ। মহামারি শুরুর পর ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য যখন ধরেছিলেন অর্থমন্ত্রী, তখন তা উচ্চাভিলাষী বলেই মত দিয়েছিলেন অনেকে।
প্রবৃদ্ধি অর্জন লক্ষ্যের কাছাকাছি না গেলেও মহামারির মধ্যেও যেটুকু অর্জিত হয়েছে, সেটাও কম নয় বলে মনে করছেন মুস্তফা কামাল।
বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারির প্রকোপ অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদক্ষ ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের কারণে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও উৎকর্ষ সাধন এবং প্রাজ্ঞ রাজস্ব নীতি ও সহায়ক মুদ্রা নীতি অনুসরণের মাধ্যমে সরকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।
‘বিগত এক দশকে বাংলাদেশের উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন কোভিড মহামারির প্রভাবে সাময়িক বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেকর্ড ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হলেও করোনাভাইরাস মহামারির কারণে তা হ্রাস পেয়ে ৫ দশমিক ২ শতাংশে দাঁড়ায়।’
‘গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ৫ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, যা ছিল এশিয়ার মধ্যে সবার উপরে,’ বলেন তিনি।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘কোভিড পরবর্তী উত্তরণের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছে।’
কী কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধি চলতি অর্থবছর কম হয়েছে এবং আগামী অর্থবছর কমিয়ে ধরতে হয়েছে, তার ব্যাখ্যাও আসে মুস্তফা কামালের কথায়।
তিনি বলেন, ‘মহামারির প্রভাব দীর্ঘতর হওয়া, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ এবং পুনরায় লকডাউন ঘোষণার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শ্লথ অবস্থা বিরাজমান। রপ্তানি ও আমদানির ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত গতি ফিরে আসেনি।’
তবে প্রবাসী আয়ে গতিশীলতা এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নকে হিসাবে ধরে বিদায়ী অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কমলেও ৬ দশমিক ১ শতাংশ হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘আশার কথা, আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংক উভয়ই বাংলাদেশের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস বাড়িয়েছে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব ব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, আগামী অর্থবছর বাংলাদেশ ৫ দশমিক ১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পেতে পারে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি আগামী বছর হতে পারে সাড়ে ৭ শতাংশ।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপন দিয়েছে, যা সরকারেরও লক্ষ্য।