করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশ ভালো অবস্থায় রয়েছে বলে দাবি করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আর এ জন্য মূল কৃতিত্ব তিনি দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দেশের মানুষকে।
মুস্তফা কামালের ভাষায়, ‘অসম্ভব’ কর্মদক্ষতা নিয়ে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার পথে চলেছেন শেখ হাসিনা। আর তাকে অব্যাহতভাবে সহযোগিতা করে চলেছেন এই দেশের ১৭ কোটি মানুষ।
তিনি বলেন, ‘মহামারির এই কঠিন সময়েও আমাদের দেশের মানুষ কাজ বন্ধ করেননি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা কাজ করে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। আমাদের দেশের মানুষ কর্মঠ, প্রচণ্ড আত্মপ্রতয়ী। জীবন-জীবিকা একসঙ্গে চালিয়ে তারা অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছেন প্রতিনিয়ত।’
মহামারির মধ্যেই আরেকটি বাজেট দিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন তিনি। এটা তার তৃতীয় বাজেট। আর বাংলাদেশের ৫০তম বাজেট।
অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল এবার তার বাজেটের শিরোনাম দিয়েছেন, ‘জীবন ও জীবিকার প্রাধান্য, আগামীর বাংলাদেশ’।
বাজেট ঘোষণার এক দিন আগে মঙ্গলবার নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, মহামারি শুরুর পর এখন পর্যন্ত ২৩টি প্যাকেজের আওতায় ১ লাখ ২৮ হাজার ৩০৩ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা, এরপর শিল্পোৎপাদন চালু করা সবই ছিল ‘সময়োপযোগী’ পদক্ষেপ।
‘পুরো দেশ এখন এর সুফল পাচ্ছে। সামষ্টিক অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্র ভালো করছে। প্রতিটি খাত উড়ন্ত অবস্থায় আছে। সব সূচকই ঊর্ধ্বমুখী। কোনো দেশেই এ অবস্থা খুঁজে পাওয়া যাবে না’, বলেন মুস্তফা কামাল।
প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসায় তিনি বলেছেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিছু অমানুষ তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে দেয়নি।
‘পিতার মতোই দেশের মানুষকে ভালোবেসে এই দেশটাকে “সোনার বাংলাদেশ” গড়ার নেশায় রয়েছেন শেখ হাসিনা। শুধু আমি নই, দেশের মানুষও এখন দেখতে পাচ্ছেন, বাংলাদেশকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কাজ করে যাচ্ছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী।’
মহামারির এই সময়ে দেয়া সাক্ষাৎকারে দেশের নতুন বাজেট নিয়ে কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। তবে গাণিতিক কোনো সংখ্যা প্রকাশ করতে রাজি হননি। বাজেটের লক্ষ্য ও ধরন নিয়ে একটা ধারণা দিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ব্যাংক খাত, পুঁজিবাজারসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। নিচে তার সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো:
রেওয়াজ অনুযায়ী বাজেট উপস্থাপনের দিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কালো ব্রিফকেস হাতে সংসদ ভবনে প্রবেশ করবেন অর্থমন্ত্রী
নিউজবাংলা: কোভিড-১৯ গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকে তছতছ করে দিয়েছে। এর মধ্যে কেমন চলছে বাংলাদেশের অর্থনীতি?
মুস্তফা কামাল: আমি আপনার প্রশ্নের উত্তরটা এভাবে শুরু করতে চাই: ২০২০ সালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে আছে শুধু বাংলাদেশ, চীন ও ভিয়েতনাম। ২০২০ সালে বাংলাদেশের যে অর্জন, আমি মনে করি এটিই বড়ভাবে দেখা যেতে পারে। কারণ, গত বছরটা ছিল আমাদের জন্য ঐতিহাসিক বছর। গত বছর আমরা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর পাশাপাশি বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছি। এই দেশের মানুষ যথাযথভাবে জাতির পিতাকে বিশ্বদরবারে আরও আলোকিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। কামার, কুমার, তাঁতি, জেলে, চাষি, ব্যবসায়ী, বিজ্ঞানীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষই কাজ করছেন। এ জন্য দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে সরকারের পক্ষ থেকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই।
আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা শেখ হাসিনার মতো একজন নেতা, একজন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছি, যিনি সামনে দেখতে পান… দেশের সব মানুষকে তিনি জানেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আগামী দেখার দক্ষতা রয়েছে। তিনি দেশের মানুষের নার্ভ বুঝতে পারেন। ওয়ান-টু-ওয়ান দেখতে পান।
মানুষকে যতটা সম্ভব দ্রুত কাজে ফেরার সুযোগ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি অর্থনীতি সচল রাখতে করোনাভাইরাসের প্রকোপের শুরুতেই এক লাখ দশ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। যখন প্রধানমন্ত্রী এই প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন, তখন আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। পুরো দেশ এখন এর সুফল পাচ্ছে। সামষ্টিক অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্র ভালো করছে। প্রতিটি খাত উড়ন্ত অবস্থায় আছে। সামনের দিকে যাচ্ছে। সব সূচকই ঊর্ধ্বমুখী। কোনো দেশেই এ অবস্থা খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, সবকিছু মিলিয়ে ভালোভাবেই অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ। সামনে আরও সুন্দর দিন অপেক্ষা করছে। বঙ্গবন্ধু যা করে যেতে পারেননি, সেগুলো করার জন্য তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলস পরিশ্রম করছেন। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) সোনার বাংলা নির্মাণের মাধ্যমে সুবর্ণরেখা স্পর্শ করবেন।
আমাদের শক্তি হচ্ছে এ দেশের মানুষ। শেখ হাসিনা এই মানুষকে ভালোবেসে, গাইডলাইন দিয়ে একদম সামনে থেকে লিড দিয়ে সামনে নিয়ে যাচ্ছেন।
মহামারি করোনাভাইসের ধাক্কা সামলে আমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে; অর্থনীতির সব সূচক এখন উর্ধ্বমুখী। কোভিড-১৯-এর আঘাতে পৃথিবীর বড় বড় দেশের অর্থনীতি যেখানে তছনছ হয়ে গেছে, আমরা সেখানে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করে মাথা উঁচু করে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছি। আর এটা সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারণে।
নিউজবাংলা: বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে আপনি জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছিলেন ৮ দশমিক ২ শতাংশ। করোনার কারণে প্রথম দফায় তা কমিয়ে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ নামিয়ে এনেছিলেন। এখন তা আরও কমিয়ে ৬ দশমিক ১ শতাংশে এনেছেন। আসলে কত হবে?
মুস্তফা কামাল: এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক- এডিবি বলছে, এবার আমাদের প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৫ থেকে ৬ শতাংশের মতো হবে। বিশ্বব্যাংক অবশ্য বলছে কম হবে; ওরা প্রতিবারই কম বলে। কিন্তু বছর গেলে হিসাব শেষে দেখা যায়, তাদের হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে। এবারও তাই হবে।
এখানে একটা কথা আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, দেশের মানুষ আত্মনিবেদিত হয়ে এবং আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। যার যতটা সুযোগ আছে, সেখান থেকেই এ দেশের অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করছেন। এতে দেশের অর্থনীতি আরও অনেক ওপরে যাবে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সারা দেশের মানুষ কাজ করে চলেছেন। ফলে আমি মনে করি, এই মহামারির কঠিন সময়েও আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের কম হবে না। আর এটা যদি হয়, তাহলেই আমরা খুশি; কেননা, পৃথিবীর অনেক দেশই এই প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে না। কোনো কোনো দেশের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হবে।
এখানে আমি আরও একটা বিষয় বলতে চাই, ইতিমধ্যে কিন্তু আমরা মাথাপিছু আয়ে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছি। পাকিস্তানকে ছাড়িয়েছি তো অনেক আগেই। শ্রীলঙ্কাকে রিজার্ভ থেকে ঋণ দিতে যাচ্ছি। আর এসব নিয়ে বাংলাদেশকে প্রশংসা করে এই তিন দেশের মিডিয়ায় প্রায় প্রতিদিনই প্রতিবেদন প্রকাশ হচ্ছে। এতেই প্রমাণিত হয়, আমরা ভালো করছি; নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যেও এগিয়ে চলেছি।
বৃহস্পতিবার আগামী অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী-ফাইল ছবি
নিউজবাংলা: দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আশার কথা শোনাচ্ছেন আপনি। সত্যিই কি অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে এসেছে?
মুস্তফা কামাল: গত কয়েক বছর ধরেই আমাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশ ভালো। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমরা ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। তার আগের বছরগুলোতেও ৭ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। কোভিড-১৯-এর কারণে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ জিডিপি অর্জিত হবে বলে আমাদের পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রাথমিক তথ্য দিয়েছে।
আমাদের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যাবে, দেশের অর্থনীতি কেমন চলছে। একটি বিষয় অবিশ্বাস্য রকম অবাক করে দিয়েছে আমাকে: এই মহামারির মধ্যেও আমাদের প্রবাসী ভাইবোনেরা রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়ে চলেছেন। চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে আসে; প্রবৃদ্ধি ৪০ শতাংশের মতো। এর আগে কোনো অর্থবছর বা বছরেও এত রেমিট্যান্স দেশে আসেনি।
সবাই যখন আশঙ্কা করেছিল, মহামারির ধাক্বায় রেমিট্যান্স একেবারে কমে যাবে। কিন্তু তা না হয়ে উল্টো বেশি বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। এতে আমরা সাহস পাচ্ছি। মহামারি মোকাবিলা করাও আমাদের সহজ হচ্ছে।
এই রেমিট্যান্সে দেশে লাখ লাখ পরিবার চলছে। ছোট ছোট ব্যবসা হচ্ছে। রেমিট্যান্স আরও বাড়বে। কারণ সরকার এ ক্ষেত্রে প্রণোদনার মাধ্যমে পাঠানোর খরচ দিয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া রেমিট্যান্স পাঠাতে যে ফরম পূরণ করতে হয়, তা সহজ করা হয়েছে।
এখানে আরেকটি কথা আমি বলতে চাই, আমি যখন পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলাম, তখনই একটা বিষয়ে আমি স্টাডি করেছিলাম। আমি হিসাব করে দেখেছিলাম, দেশে সব মিলিয়ে ৩৪-৩৫ বিলিয়ন ডলারের মতো রেমিট্যান্স দেশে আসত। এর মধ্যে অর্ধেকেরও কম ১২ থেকে ১৪ বিলিয়ন ডলার আসত ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বৈধ পথে। বাকিটা আসত হুন্ডির মাধ্যমে অবৈধ পথে।
এখন ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেয়ার কারণে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোর পরিমাণ অনেকটা কমেছে। এটাকে একেবারে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার চেষ্টা করছি আমরা।
নিউজবাংলা: অর্থনীতির আরেক গুরুত্বপূর্ণ সূচক বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভও বেশ সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে। রিজার্ভ কি আরও বাড়বে বলে আপনার মনে হয়?
মুস্তফা কামাল: আমাদের আরেকটি স্বস্তির বিষয় হচ্ছে রিজার্ভ। মূলত রেমিট্যান্সের ওপর ভর করেই বর্তমানে আমাদের রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন ডলারের ওপরে অবস্থান করছে। এ বছরের মধ্যেই রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করবে বলে আমি প্রত্যাশা করছি।
নিউজবাংলা: প্রধানমন্ত্রী রিজার্ভ বিনিয়োগে নিয়ে আসার কথা বলেছেন। এ বিষয়ে কী ধরনের চিন্তাভাবনা করছেন?
মুস্তফা কামাল: প্রধানমন্ত্রীর কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে আমরা সরকারি প্রকল্পে রিজার্ভ থেকে অর্থায়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণের মতো প্রকল্পে এই অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছি। বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ নিলে ৪ থেকে ৫ শতাংশ সুদ দিতে হয়। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিদেশে বিনিয়োগ করলে এক থেকে দেড় শতাংশের বেশি সুদ পাওয়া যায় না। ফলে এই অর্থ সরকার ব্যবহার করলে রাষ্ট্রেরই লাভ।
আমরা সেই কাজটিই শুরু করে দিয়েছি ইতিমধ্যে। রিজার্ভ থেকে প্রথম ঋণ পাচ্ছে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ। ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা, যা দেয়া হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একক মুদ্রা ইউরোয়। ১০ বছর মেয়াদে এই ঋণ দেবে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। এর মধ্যে তিন বছর গ্রেস পিরিয়ড। সোনালী ব্যাংক বাংলাদেশি টাকা দিয়ে ইউরো কিনে এই ঋণ দেবে।
নিউজবাংলা: অর্থনীতির অন্য সূচকগুলো সম্পর্কে কিছু বলবেন?
মুস্তফা কামাল: আমি যখন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিই, তখন বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্য (ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট) ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি নেতিবাচক ছিল। এখন তা ইতিবাচক। কোভিড-১৯-এর কারণে আমাদের রপ্তানি আয়ে ধাক্কা লেগেছিল, সেটা কেটে গেছে। এই অর্থবছরের ১১ মাসে অর্থাৎ জুলাই-মে সময়ে ৯ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। মহামারির ধাক্কা সামলে উঠতে আমাদের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে ১০ হাজার কোটি টাকার মতো প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দ্রুত এই বিচক্ষণ ঘোষণা রপ্তানি বাণিজ্য দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করেছে বলে আমি মনে করি।
অন্য সূচকগুলোর মধ্যে বরাবরের মতোই আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখেছি। প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের ফলে বিনিয়োগেও গতি ফিরে এসেছে। গত কয়েক মাস ধরে আমদানি ব্যয়ও বাড়ছে। আশা করছি, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তা ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।
নিউজবাংলা: আপনি বলছিলেন, নতুন বাজেটের গাণিতিক কোনো সংখ্যা প্রকাশ করবেন না। বাজেটের লক্ষ্য ও ধরন নিয়ে খানিকটা ধারণা দেবেন, প্লিজ।
মুস্তফা কামাল: বাজেট কেমন হচ্ছে, কী থাকছে তা জানার জন্য বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সেদিন সংসদে প্রচারিত হবে, সত্যিকার তথ্য আপনাদের সামনে চলে আসবে। এটা কোনোভাবেই আমরা ডিসক্লোজ করতে পারি না। তবে জেনারেলি আমরা এই কথা বলতে পারি যে, আমাদের লক্ষ্যই থাকবে দেশের মানুষকে বাঁচানো; ব্যবসায়ীদের বাঁচানো। সবার সবকিছু দেখেই আমরা এবার বাজেট উত্থাপন করব।
আমাদের সব পিছিয়ে পড়া মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে রাখতে হবে। তাদের সঙ্গে রেখেই এগিয়ে যেতে চাই। সে কারণেই এভাবে বলতে চাই, আগামী বাজেট হবে ‘জীবন ও জীবিকা রক্ষার’ বাজেট।
সমাজের অতিদরিদ্র মানুষকে মূলধারায় নিয়ে আসা, গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করা এবং মহামারির কারণে বিধ্বস্ত ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলোকে টিকে থাকার সুযোগ করে দেয়ার কৌশল অবশ্যই থাকবে নতুন বাজেটে।
নিউজবাংলা: অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক ভালো থাকলেও বিনিয়োগে স্থবিরতা কিন্তু কাটছে না। এবারের বাজেটে বিনিয়োগ বাড়াতে কি পদক্ষেপ নেয়া হবে।
মুস্তফা কামাল: সামষ্টিক অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবিলায় বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোই আমাদের লক্ষ্য। বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে। এ জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন জোগান দিতে সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি অব্যাহত রাখা হবে। গত বছরের এপ্রিল থেকে ব্যাংকঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ বাস্তবায়ন হচ্ছে। অর্থনীতির গতিশীলতার জন্য অনেক আগে থেকেই মুদ্রানীতি সম্প্রসারণমূলক রয়েছে। সুতরাং ভাবার কোনো কারণ নেই, একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ বিনিয়োগ হয়ে গেছে, ফলে আর নতুন বিনিয়োগ হবে না। অর্থনীতিতে গতি আনতে আরও নীতি-সহায়তা প্রয়োজনা হলে অবশ্যই দেয়া হবে।
এখানে আরেকটি বিষয় বলে রাখা খুবই প্রয়োজন বলে আমি মনে করছি: এই যে ৯ শতাংশ সুদহার বাস্তবায়ন করা হয়েছে, এটার পুরো কৃতিত্ব কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, শিল্পায়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জন করতে সুদহার কমাতে হবে। নতুবা আমরা কারোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকব না। এ জন্য ব্যাংকঋণের সুদহার কমানোও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ছিল। যার সুফল এখন ব্যবসায়ী, ব্যাংক সবাই পাচ্ছে।
অনেকেই বলেছিল, ব্যাংক এই সুদহারে কাজ করতে পারবে না। আমি বলেছিলাম, লোকসান হবে না। কারণ ১৪ বা ১৫ শতাংশ সুদে ঋণ দিয়ে বছর শেষে বড় অঙ্কের রাইট-অফ করতে হচ্ছে। কম সুদে কম আয় করলেও নিট আয় বেশি থাকবে, যদি রাইট-অফ করতে না হয়। এখন যে তথ্য পাচ্ছি, ব্যাংকগুলো ভালো ব্যবসা করছে। কোনো কোনো ব্যাংক ৯ শতাংশের কম সুদেও ঋণ দিচ্ছে।
নিউজবাংলা: রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর তো কোনো উন্নতি হচ্ছে না। সার্বিক ব্যাংক খাত নিয়ে কিছু বলবেন?
মুস্তফা কামাল: আমি আসার আগে প্রতিটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে প্রতিবছর সুন্দরভাবে মূলধন সরবরাহ করা হতো। মূলধন না দিলে তারা চলতে পারত না। আমি তাদের সঙ্গে একটা সভা করে সুস্পষ্টভাবে বলেছি, মূলধন আর সরবরাহ করা হবে না। উপার্জন বাড়িয়ে নিজেদের তহবিলে চলতে হবে।
এখন আর কাউকে টাকা দিতে হচ্ছে না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো মুনাফা করছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো প্রতিটি মুনাফা করছে। ব্যাংকগুলোকে এখন আর তহবিল নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে না।
খেলাপি ঋণ কমানোরও নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আশা করছি, ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।
নিউজবাংলা: দীর্ঘদিন ধরে পুঁজিবাজারে খারাপ অবস্থা চলছিল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে এই মহামারির মধ্যে বাজার চাঙাভাবে ফিরেছে। এর পেছনে কী কারণ দেখছেন আপনি?
মুস্তফা কামাল: আমাদের পুঁজিবাজার এখন অনেক শক্তিশালী। অন্য সময় ব্যাংক থেকে টাকা না দিলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে আসত না। এখন কিন্তু রেমিট্যান্সের টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হচ্ছে। পুঁজিবাজারে লেনদেন বাড়ছে; সূচক বাড়ছে।
এটি অর্থনীতির আরেকটি খাত, যেখানে অনেক মানুষ সম্পৃক্ত। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা- বিএসইসিকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসছে। আশা করছি, একটি ভালো পুঁজিবাজার আমরা দেখতে পাব।