আমরা এলডিসি উত্তরণের কথা বলছি। মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছি। মধ্যম আয়ের দেশে যেতে হলে মধ্যম আয় যারা করে, তাদের রক্ষা করতে হবে। মধ্যম আয়ের মানুষদের সুরক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ থাকতে হবে, বাজেটে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দও রাখতে হবে।
ব্যবসার ক্ষেত্রেও মধ্যম স্তর বা স্থানীয় শিল্পায়ন প্রমোট করতে হবে। স্থানীয় শিল্পের আত্মবিশ্বাস বাড়ানো গেলে, উন্নতি হলে, তাদেরকে দেখে বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদশে আসবে। কারণ, যাদের কথা শুনে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আশ্বস্ত হন, তারা হচ্ছেন ব্যবসায়ী। সরকারের উচিত ব্যবসায়ীদেরকে উদাহরণ হিসাবে তৈরি করে, তাদেরকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসাবে সামনে রেখে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা।
ব্যবসা বিকাশের ক্ষেত্রে উচ্চ কর হার একটি বাধা। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া – এ সব দেশে ২০ শতাংশের মতো করপোরেট কর। কিন্তু আমাদের দেশে তা ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ। তাই আমরা চাই প্রতিবছর আড়াই শতাংশ করে আগামী তিন বছরের বাজেটে করপোরেট কর কমিয়ে ২৫ শতাংশে নেমে আসুক। যদিও এ ২৫ শতাংশ কর হার সার্ক এভারেজ, এশিয়া এভারেজ এবং গ্লোবাল এভারেজের চেয়েও বেশি হবে। তবে বর্তমান অবস্থার চেয়ে অন্তত বেশি প্রতিযোগিতামূলক হবে।
নতুন বাজেটে করপোরেট কর হ্রাসের একটা খরব শুনতে পাচ্ছি। সত্যিই যদি কমে, এটা একটা ভালো খবর হবে। এতে ব্যবসায়ীদের আস্থা অনেক বাড়বে। এ মুহূর্তে ব্যবসা ক্ষেত্রে অনেকটাই মন্দা যাচ্ছে। বাজারের অবস্থা খারাপ। এ অবস্থায় করপোরেট ট্যাক্স কমানোর কথা ইতিবাচক ইঙ্গিত।
সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মমসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয় না। এ বছরও ২ লাখ কোটি টাকার এডিপি রয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়ন কাঙ্খিত নয়। প্রকল্পের মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এ দুর্বলতা দূর করতে হবে। যেসব প্রকল্প মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলে এবং সরকারের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় অর্থ ও পদক্ষেপ নিতে হবে।
কর হার কম হলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য তৈরি হতে ব্যবসায়ীরা আরও আগ্রহী হবে, বিনিয়োগে আসবে। ব্যবসার নতুন নতুন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তবে ব্যবসায়ীরা ‘আউট অব দ্য বক্স’ (প্রচলিত ব্যবসার বাইরে) ব্যবসা করতে চান না। সবাই যে খাতে আছেন, সেই খাতেই ব্যবসা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাই নতুন খাতে ব্যবসা সৃষ্টির জন্য তাদের প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে।
করোনায় শিক্ষা খাতেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তাই আগামী বাজেট শিক্ষা খাত নিয়ে বিশেষ গাইডলাইন থাকতে হবে। স্কুলগুলোকে ডিজিটালাইজ করতে হবে। তাহলে কোনো অবস্থাতেই স্কুল বন্ধ থাকবে না। ব্যবসায়ীদের শিক্ষা খাতে আনতে হবে। শিক্ষা খাত ডিজিটালাটাইজ করার ক্ষেত্রেও ব্যসায়ীদের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) অর্থ শিক্ষা খাতে আনা যায়। কর ছাড় বা প্রণোদনার বিনিময়ে তাদের বিভিন্ন স্কুলের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া যায়।
গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া লিংকেজ তৈরি করা। যেমন, যত ডাক্তার বাংলাদেশে আছে, সে অনুপাতে নার্স নেই। যত অটোমেটেড ফ্যাক্টরি আছে, সে অনুপাতে দক্ষ কর্মী নেই। যত গাড়ি বানানোর অ্যাসেম্বলিং প্ল্যান্ট আছে, তত ইঞ্জিনিয়ার নেই। কোন খাতে, কোন ধরনের, কত কর্মী প্রয়োজন তা ডিসাইড করবে ইন্ডাস্ট্রি, একাডেমিশিয়ান নয়।
এই যে চতুর্থ শিল্প বিল্পব, এর মানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে ভাবতে হবে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রোবোটিক্স ডিপার্টমেন্ট চালু করতে হবে, ফাইভ জি টেকনোলজি নিয়ে ভাবতে হবে। এ কাজে ব্যবসায়ীদের সাহায্য নেয়া যায়। ব্যবসায়ীদের বলা হোক আপনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিন, ২০ কোটি টাকা দিয়ে একটা ল্যাব তৈরি করে দিন। এর বিনিময়ে এত শতাংশ কর দিতে হবে না। তাহলেই হয়ে যায়। কারণ সরকার তো কর নিয়ে এসব খাতেই ব্যয় করবে। ব্যবসায়ীরা সরাসরি দিলে অযথা বিলম্বও কম হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে স্বাস্থ্য খাত। আমাদের স্বাস্থ্য খাতকে আরও উন্নত করতে হবে। মহামারি করোনা প্রতি মুহূর্তে সেই শিক্ষা দিচ্ছে। আর যদি এরপরও আমাদের শিক্ষা না হয়, তাহলে আগামী একশ বছরেও শিক্ষা হবে না।
আমি স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বাড়াতে বলব না। আমি বলব, এ খাতের দুর্নীতি কমানো হোক। একটি হাসপাতাল বেডের জন্য ৮৫ হাজার টাকা খরচ আর নয়। বাজেট বরাদ্দ তো আছে। বছরের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত যে খরচ হয়, দুই মাসে বাকিটার আর হিসাব থাকে না। এ জন্য জবাবদিহিতা থাকতে হবে। স্বাস্থ্যখাতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে উৎসাহ দিতে হবে। বিশেষ করে গ্রামীণ পর্যায়ে স্বাস্থ্য খাতের পরিসর বাড়াতে হবে। প্রান্তিক এলাকায় ডাক্তারদের বিশেষ প্রণোদনা দিতে হবে।
তবে, সক্ষমতা বাড়লে এ খাতে ৫০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেও ক্ষতি নেই, বরং তা সঞ্চয়। কারণ চিকিৎসার পেছনে বছরে ১১ বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে চলে যায়। তা আমরা হিসাব করি না। দেশের চিকিৎসা খাতের প্রতি আস্থা না থাকায় যাদের সামর্থ্য আছে, তারা জ্বর হলেও দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য যান। উন্নত দেশ তখনই হবে, যখন মানুষ পিঠের ফোঁড়া হলে তার চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক যাবে না। এতো টাকা খরচ করে মানুষ বিদেশে যায়, কারণ দেশে সে মানের চিকিৎসা সেবা নেই।
বাজেটে অতি-ধনীদের উপর কর বা ওয়েলথ ট্যাক্স বাড়বে। আমি এটাকে সমর্থন করি। আমার সামর্থ্য আছে, আমি দিব। তবে আমার অর্থ যেন সরাসরি কটেজ, মাইক্রো অ্যান্ড স্মল ইন্ডাস্ট্রিতে যায়; যাতে নিচের দিকে যারা আছে, তারা ধীরে ধীরে আমার পর্যায়ে উঠে আসতে পারে। ব্যবসায়ীরা ট্যাক্স দিতে তখনই নিরুৎসাহ দেখান, যখন দেখেন তাদের ট্র্যাক্সের বিনিময়ে তেমন কিছু পাচ্ছেন না।
এখনও স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তারা বলেন, তাদের সহজ শর্তে অর্থায়নের ব্যবস্থা নেই, তারা ফাইন্যান্স পান না। তাদের জন্য পর্যাপ্ত ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।
সব শেষ কথা, সরকার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলেও আমি ব্যক্তিগতভাবে তা কখনও সমর্থন করি না। গত ছয় দশকে ঢাকা চেম্বারও এটাকে সমর্থন করেনি, করেও না। এতে সাদা টাকার চেয়ে কালো টাকাকে সম্মান বেশি করা হচ্ছে। প্রকৃত ব্যবসায়ীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। কালো টাকা বিনা প্রশ্নে বিনিয়োগের সুযোগ কেন দিতে হবে? সরকার ব্যবসায়ীদের নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে। কালো টাকা তো চুরি, তাহলে কেন কালো টাকা নিয়ে প্রশ্ন করা হবে না?
তবে কালো টাকা ও অপ্রদর্শিত আয় এক না। এ দুটির আলাদা সংজ্ঞা ঠিক করতে হবে। কোনো ব্যবসায়ীর অজ্ঞাতে বা অন্য কোনো কারণে এক বা দুই বছর কোনো টাকা তার আয় থেকে দেখানো বাদ পড়তে পারে। কিন্তু এ অপ্রদর্শিত অর্থ আর প্রকৃত অর্থে কালো টাকা এক নয়। চোরাচালান, অর্থপাচার বা ঘুষের টাকাকে অপ্রদর্শিত অর্থের থেকে আলাদাভাবে দেখতে হবে।
রিজওয়ান রাহমান: সভাপতি, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবু সাইম