মহামারি করোনাভাইরাসের আঘাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও তছনছ হয়ে গেছে। পাল্টে গেছে সব হিসাব-নিকাশ।
অদৃশ্য এই ভাইরাসের সংক্রমণ বিশ্বকে নতুন করে ভাবাচ্ছে। যতদিন এই ভাইরাসটিকে তাড়ানো না যাবে, ততদিন কোনো কিছুতেই স্বস্তি আসবে না। আর এ জন্য প্রয়োজন দেশের সব মানুষের টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা।
সে কারণেই নতুন বাজটে সরকারের টিকাকরণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
‘স্বাস্থ্য ভালো থাকলে দেশ ভালো থাকবে’—এই ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে করোনা মহামারি পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং টিকাকরণের জন্য এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে অবশ্যই বরাদ্দের পরিমাণ বাড়াতে হবে। করোনা সংক্রমণ কতদিন চলবে, তা কেউ জানে না। কাজেই করোনা নিয়ন্ত্রণই এ মুহূর্তে সবার কাছে প্রধান আকাঙ্ক্ষা।
করোনা থাকলে যোগাযোগ, যাতায়াত, শিক্ষা, ব্যবসা, পর্যটন কোনো কিছুই স্বাভাবিকভাবে হবে না। আর সবকিছু স্বাভাবিক না হলে অর্থনীতির গতিও স্বাভাবিক হবে না। করোনার প্রধান দাওয়াই হচ্ছে টিকা। ব্যাপকভাবে টিকাকরণের ওপর তাই সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে আসন্ন বাজেটে।
টিকা কেনা বা দেশে বানানো, প্রক্রিয়া যাই হোক না কেন, টিকার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই টিকা ব্যাপকভাবে প্রয়োগের জন্যও উদ্যোগ থাকতে হবে। নিঃসন্দেহে এবারের বাজেটে টিকাকরণকে আমি প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে দেখতে চাই।
জেলা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যন্ত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, যন্ত্রপাতি ও ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় ভেন্টিলেটর, আইসিইউ, অক্সিজেন সরবরাহ সুবিধা, এক্স-রে ও সিটি স্ক্যান মেশিন ইত্যাদির জোগান নিশ্চিত করতে হবে।
করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষা খাতকেও অগ্রাধিকার তালিকায় রাখতে হবে। গত বছরের মার্চ মাস থেকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, শিক্ষক-ছাত্র-অভিভাবক সবাই প্রায় দিশেহারা। দেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীকে অনলাইন ক্লাসের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন।
স্মার্ট ফোন, ট্যাব, ইন্টারনেট সংযোগ ইত্যাদি সব শিক্ষার্থীর জন্য সুলভ করতে হবে। দীর্ঘস্থায়ী করোনায় নতুন বাস্তবতা বা নিউ নরমালের সঙ্গতি বিধান করে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার জন্য জাতীয় আয়ের অন্তত ৬ শতাংশ শিক্ষায় খরচ করতে হবে।
সড়ক যোগাযোগ ও পরিবহন খাতে বরাদ্দ দুর্ঘটনা রোধে ব্যবহার করতে হবে। সড়ক উন্নয়ন, নৌ ও রেলপথের বিস্তৃতি ও উন্নয়ন ইত্যাদির পাশাপাশি দুর্ঘটনা রোধে আধুনিক যন্ত্রপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
সড়কের মান ও জনঘনত্ব বিবেচনায় যান চলাচলের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এমন প্রযুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে যাতে নির্দিষ্ট গতিসীমা অতিক্রম করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই যানবাহনের বিস্তারিত তথ্য (রেজিস্ট্রেশন নম্বর ইত্যাদি) নথিভুক্ত হয় এবং সেই যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়।
যুবদের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটিয়ে বিভিন্ন দেশে কাজের সুযোগ করে দেওয়া যায়। কোন দেশে কোন ধরনের দক্ষ শ্রমিক দরকার তা জেনে সেই অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা গ্রহণ করলে বেকার সমস্যার যেমন সমাধান হবে, পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রাও আসবে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতেও বাজেট বাড়ানো দরকার। পাশাপাশি গবেষণা খাতে বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে। সংক্রামক ব্যাধি ও রোগ নিয়ন্ত্রণ, কৃষি গবেষণা এবং নতুন নতুন উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি বিকাশে আরও বাজেট বাড়ানো দরকার।
কৃষকরা ধান মাড়াই করার সময় শ্রমিক পায় না। তারা যেন সস্তায় ধান মাড়াই যন্ত্র কিনতে পারে, তাহলে অনেক বেশি লাভবান হতে পারে। এসব দিকে নজর দেয়া দরকার। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহারেও নজর দিতে হবে।
আয়করের হার কমাতে হবে। কর-ছাড় পাওয়ার যে ধারাগুলো চালু করলে গরিব ও মধ্যবিত্তরা উপকৃত হয়, তা কার্যকর করতে হবে। গরিব-মধ্যবিত্তদের ওপর করের বোঝা না বাড়িয়ে করের আওতা বাড়াতে হবে।
বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানের (বিয়ে, জন্মদিন, অন্যান্য দাওয়াত) ওপর কর ধার্য এবং বিত্তবানদের ওপর অধিক হারে কর আদায়ের মতো সৃজনশীল উদ্যোগ নিতে হবে।
কর প্রদানের পদ্ধতি সহজ ও ডিজিটাল করতে হবে।
জিনিসপত্রের দাম যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষকে যেন নাকাল হতে না হয়, এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও দিকনির্দেশনা বাজেটে অবশ্যই থাকতে হবে।
চাল, ডাল, আলু, তেল লবণ ও পেঁয়াজ এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ যেন কোনো অবস্থাতেই ব্যাহত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
চিররঞ্জন সরকার: ব্র্যাকের উন্নয়নকর্মী
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবদুর রহিম হারমাছি