করোনাভাইরাসে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি মোকাবিলায় আসন্ন বাজেটে স্বাস্থ্য খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার। বরাদ্দ অনেক বাড়ানো হচ্ছে।
তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না। স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে মন্ত্রণালয় থেকে তৃণমূল পযন্ত শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে দুর্নীতির শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে।
একই সঙ্গে স্বাস্থ্য সেবার প্রতিটি স্তরে আমূল সংস্কার করে পুরো স্বাস্থ্যখাতকে ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দেয়ার কথা বলেছেন তারা।
স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি নতুন বিষয় নয়। তবে করোনাকালে দুর্নীতিতে সমালোচিত স্বাস্থ্যখাত। করোনাকালে মাস্ক ও ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী কেনাকাটায় দুর্নীতি, কোভিড-১৯ পরীক্ষার নামে জালিয়াতি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়ি চালকের অঢেল সম্পদের খোঁজসহ নানা অভিযোগে ব্যাপক সমলোচিত স্বাস্থ্যখাত।
অবশ্য করোনাকালেই যে স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি প্রকাশ্যে এসেছে, তা নয়। এর আগে থেকে এ খাতের কেনাকাটা, নিয়োগসহ নানা দুর্নীতির খবর প্রকাশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। দুর্নীতি রোধে কয়েক দফা সুপারিশ করা হলেও এর কোনোটিই বাস্তবায়ন হয় নি।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বহুদিন ধরে স্বাস্থ্যখাতে যে অনিয়ম চলে আসছে, সেটি দূর করে স্বাস্থ্যসেবায় মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই হব না, পাশাপাশি অর্থ যাতে সঠিক ব্যবহার করা হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্যখাতে বাজেট কম, এটা যেমন সত্যি, তেমনি বাজেটে দেয়া অধিকাংশ বরাদ্দ দুর্নীতিবাজদের পকেটে চলে যায়।
তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্যখাতে কোথায় কী প্রয়োজন, তার সঠিক পরিকল্পনা হয় নি। করোনা-পরবর্তী স্বাস্থ্য বাজেটকে ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দেন তিনি।
দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি নতুন বিষয় নয়। কিন্তু করোনায় দেশের স্বাস্থ্যখাতের আসল চেহারা খুলে দিয়েছে এই খাতটি কতটা দুর্বল। দুর্নীতি রোধ করতে না পারলে এ খাতে কখনই শৃঙ্খলা ফিরে আসবে না।
১২ শতাংশ বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব
অর্থমন্ত্রণালয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন মিলে সর্বসাকুল্যে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হচ্ছে। এটি চলতি অর্থবছরের বরাদ্দের চেয়ে প্রায় ১২ শতাং বেশি।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে মোট বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা।
নতুন বাজেটে উন্নন বাজেটে এডিপিতে বরাদ্দ দেয় হয় ১৭ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের এডিপির চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরে এডিপিতে বরাদ্দ ১৩ হাজার ৩৩ কোটি টাকা।
উন্নয়ন এবং অনুন্নয়ন খাতে বরাদ্দের বাইরে করোনোর টিকা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনতে ১০ হাজার কোটি টাকা আলাদা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থমন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে যেমন খরচের একটা নির্দিষ্ট সীমা দেয়া রয়েছে, স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে তা দেয়া হয় নি। করোনা মোকাবিলয়া যা খরচ দরকার হবে তাই যোগান দেয়া হবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, এবার বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার বাজেট সহায়তার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এর বেশির ভাগই করোনা রোধে ব্যয় সংক্রান্ত।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, স্বাস্থ্য বাজেটে বরাদ্দের ৬৫ শতাংশ ব্যয় হয় বেতন-ভাতা ও কেনাকাটায়। ফলে এ খাতে উন্নয়ন খাতে আরও বেশি বরাদ্দ দেয়া উচিত।
তবে এটা ঠিক যে, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয় তা জিডিপির তুলনায় অনেক কম। এটা এখন জিডিপির ১ শতাংশের কিছু বেশি, যা প্রতিবেশি অনেক দেশের তুলনায় কম।
এটি কমপক্ষে জিডিপির ৪ শতাংশে উন্নীত করা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বর্তমানে ভারতে স্বাস্থ্যে দেয়া বরাদ্দ সে দেশের জিডিপির আড়াই শতাংশ। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ১০ শতাংশের বেশি খরচ করে।
পরিসংখ্যান বলে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দের হার দক্ষিণ এশিয়ার যে কোনো দেশের চেয়ে কম।
জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিকের (এসকাপ) ২০১৮ সালের জরিপে বলা হয়েছে, জিডিপি অনুপাতে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ৫২টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
সাবেক অর্থ সচিব ও বর্তমানে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) মুহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্যখাতে অবকাঠামো ও গবেষণায় দুর্বলতা প্রকট। দুর্নীতিও একটা বড় সমস্যা। এসব বিষয়ে নজর দিতে হবে। একই সঙ্গে করোনা-পরবর্তী স্বাস্থ্য খাতকে প্রাধান্য দিয়ে বরাদ্দ অনেক বাড়াতে হবে।
বাজেটে যা থাকতে পারে
আসন্ন বাজেটে আরও ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবায় নতুন জনবল নিয়োগের প্রস্তাব থাকছে। এ জন্য আলাদা বরাদ্দ থাকছে। করোনা প্রতিরোধ কর্মকাণ্ড ও সচেতনতা বাড়াতে পরিবারকল্যাণ বিভাগকে বাড়তি ২৫০ কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে।
এ ছাড়া সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, করোনা চিকিৎসায় পৃথক আইসোলেশন ইউনটি চালু, সুরক্ষা সামগ্রী আমদানি বাড়ানো, প্রশিক্ষণ ও গবেষণায় বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব থাকছে।
করোনা সংক্রমণ রোধে দেশের সক্রিয় ২৫টি স্থলবন্দরে মেডিকেল সেন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সার্জিক্যাল মাস্ক, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানি, ডাক্তার-নার্সদের প্রশিক্ষণে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে আসন্ন বাজেটে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ডা. শাহ মনির হোসেন বলেন, কোভিডপরবর্তী জনস্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে এ খাতে অবকাঠামো শক্তিশালী ও মানবসম্পদের ঘাটতি পূরণ করতেই হবে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার আমূল সংস্কার করতে হবে।
সংস্কারের পরামর্শ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যসেবার তিনটি স্তর আছে: প্রাথমিক, মধ্যম ও তৃতীয় পর্যায়। এ তিনটি স্তরে স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে হবে।
প্রাথমিক স্তর তথা উপজেলা ও ইউনিয়ন হবে মূল লক্ষ্য। এখানে সরকারি ব্যয় আরও বাড়াতে হবে। জেলা পর্যায়ে ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। আর কেন্দ্রীয়ভাবে যেসব হাসপাতাল ও কলেজ রয়েছে, সেগুলোকে ভিন্ন আঙ্গিকে সংস্কার করতে হবে।
গবেষণা খুবই দুর্বল। এ ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। ওষুধের দাম নির্ধারণে সরকারের জোরালো ভূমিকা রাখা দরকার। পুরোনো কাঠামো ভেঙে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা চালু করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ডাক্তার মাহবুব-ই-রশিদ বলেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা নিতে হবে। বাজেটে টাকা বরাদ্দের একটা ভূমিকা আছে। কিন্তু তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা পুরোনো মডেলের। এটা দিয়ে দেশের জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণ সম্ভব নয়। সংস্কার অবশ্যই করতে হবে।