বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অশুভ ছায়া সরবে কবে?

  •    
  • ২৪ আগস্ট, ২০২১ ১৪:০৪

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নানামুখী অস্থিরতাকে আলাদাভাবে না দেখে পরিশুদ্ধ নীতি নির্ধারণ করতে হবে। যদি আমাদের রাষ্ট্র ও রাজনীতি মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় দেশের মেরুদণ্ড তৈরি করবে তবে অবশ্যই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এর আদর্শিক অবস্থান ফিরিয়ে দিতে হবে। রাজনীতির নামে দলীয়বৃত্তের আধিপত্য থেকে মুক্ত করতে হবে।

কম করেও যদি বলি তবে বলব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আদর্শিক জায়গা থেকে এর সৌন্দর্য হারিয়ে গত তিন দশক ধরে নানা ধারার অস্থিরতায় ভুগছে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্ত্বশাসন নিশ্চিত করতে এবং একটি গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠিত করতে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ আইন জারি করেন। কিন্তু দিনে দিনে এর ফল-বিকৃতি ঘটতে লাগল। রাজনীতিতে যেমন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অপব্যবহার হয় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহেও ১৯৭৩-এর আইনের অপব্যবহার হতে থাকে। একসময়ে এই আইনে চলা আর আইনে না চলা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ কর্মভূমিকা ও আচরণে হরেদরে এক হয়ে যায়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক নিম্নমুখীনতা আর ঠেকানো যাচ্ছে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বছরজুড়ে নানামুখী অশান্তি চলে। ভিসিবিরোধী আন্দোলন, পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে একশ্রেণির ছাত্র ভাঙচুর, সরকারি ছাত্র সংগঠনের তৈরি অরাজকতা। এসব তালিকার যেন শেষ নেই। যার ফলে সার্বিক নিরাপত্তায় সংকট দেখা দেয়ায় অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে হয়। সরকারি ছাত্র সংগঠনের প্রাক্তন নেতাকর্মীরা নিকট অতীতে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাওয়ার দাবিতে প্রতিষ্ঠান অচল করে দিয়েছিল।

একবার দলীয় কর্মীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দিতে বাধ্য করার জন্য রাজশাহীর দায়িত্বপূর্ণ আওয়ামী লীগ নেতারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের ওপর চড়াও হয়েছিলেন। নতুন ভবনে তিনটি বিভাগের শিক্ষক যার যার দখল নিশ্চিত করতে কিছুকাল আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অভূতপূর্ব ও নিম্নমানের এক আন্দোলনে দেখতে হয়েছিল আমাদের। প্রশাসন নানাভাবে চেষ্টা করেও সুরাহা করতে পারেনি তখন। অবশেষে গ্রীষ্ম ও রমজান-ঈদের ছুটি লম্বা করে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ দিয়ে আপাতত স্বস্তি খুঁজেছে। এছাড়াও প্রায় সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই ছোট বড় ক্ষোভ ও উত্তেজনা রয়েছে।

আমার যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বন্ধু দীর্ঘদিন সেখানে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের এক নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছেন। তার কাছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অশান্তির চরিত্র স্পষ্ট ছিল না। তিনি সরল প্রশ্ন করলেন, এ দেশেতো সিংহভাগ ছাত্রছাত্রী এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। সেখানে নিরবচ্ছিন্নভাবে ক্লাস পরীক্ষা চলছে। শিক্ষার্থীরা সময়মতো ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছে, তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দশা কেন? আমি খুব সরল উত্তর দিলাম তাকে।

বললাম, তোমার প্রতিষ্ঠানের মতো এমন এ গ্রেডের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থীকে চার বছর পড়ে স্নাতক ডিগ্রি নিতে (আবাসিক ব্যবস্থা ছাড়াই) দশ থেকে বারো লাখ টাকা বা এর চেয়েও বেশি খরচ করতে হয়। ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি এসব প্রতিষ্ঠানে নিষিদ্ধ। শিক্ষকদের চাকরি পাওয়া ও টিকে থাকা নির্ভর করছে কর্তৃপক্ষের ইচ্ছের ওপর। উপাচার্য যে ক্ষমতা ধারণ করেন তাকে নিয়ে মালিকপক্ষ ছাড়া আর কারো প্রশ্ন করার অবকাশ নেই। এই পরিবেশে মুক্তচিন্তাচর্চার অবকাশ কম থাকলেও শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর যার যার অর্পিত দায়িত্ব পালন ছাড়া আর কিছু করণীয় নেই। অপরদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থী চার বছরে তার স্নাতক সম্পন্ন করতে পারবে এর কোনো গ্যারান্টি নেই। তবুও চার বছরে একজন শিক্ষার্থীকে হলে থাকা খাওয়াসহ টিউশন ফি ও অন্যান্য খরচ মেটাতে একলাখ টাকা খরচ করলেই চলে। সংকটের এক ধরনের উৎস খুঁজতে হবে এখানেই।

ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি দায়িত্ব, কর্তব্য ও নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়েছে। ক্ষমতাসীন জাতীয় রাজনীতির প্রশ্রয়ে সব পর্বেই একটি অন্ধকার গ্রাস করে ক্যাম্পাসকে। উপাচার্য নিয়োগ থেকে সর্বত্র চলে দলীয়করণ। দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। অনেক কাল থেকেই ছাত্র রাজনীতি আর ছাত্র কল্যাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে না। ক্ষমতার রাজনীতির প্রশ্রয়ে ছাত্র-শিক্ষক সব রাজনীতির অঙ্গনে দুর্বৃত্ত আচরণ স্পষ্ট হচ্ছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও রাজনীতির ছকটা এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে, রাজনৈতিক পরিচয় না থাকলে প্রকৃত মেধাবী ছাত্রটি অনেক ক্ষেত্রেই নিজের যোগ্য জায়গায় ঠাঁই পাচ্ছে না।

রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষক কখনও উপাচার্য থেকে শুরু করে কোনো সম্মানিত পদ পাবেন না বিষয়টি একেবারে নিশ্চিত হয়ে আছে। এমন বাস্তবতায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অস্থিরতা বিরাজ করবেই। নানা উপলক্ষেই এই বিষবাষ্প ছড়াবে। অস্থির হবে ক্যাম্পাস। এ কারণে আমরা মনে করি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নানামুখী অস্থিরতাকে আলাদাভাবে না দেখে পরিশুদ্ধ নীতি নির্ধারণ করতে হবে। যদি আমাদের রাষ্ট্র ও রাজনীতি মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় দেশের মেরুদণ্ড তৈরি করবে তবে অবশ্যই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এর আদর্শিক অবস্থান ফিরিয়ে দিতে হবে। রাজনীতির নামে দলীয়বৃত্তের আধিপত্য থেকে মুক্ত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, প্রশাসন অন্ধকার সংকীর্ণ গলিতে ঘুরপাক না খেয়ে যেদিন বৈশ্বিক প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গী অর্জন করতে পারবে সেদিনই মুক্তি পাবে এদেশের শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্র।

দলবৃত্তে বন্দি থেকে ক্ষমতা ও সুবিধার লক্ষ্যপূরণ করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতি অনেক বেশি কলুষিত হয়ে গেছে। প্রশাসন বা উপাচার্যের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে কালেভদ্রে সর্বাত্মক আন্দোলন হয় ক্যাম্পাসে। বাকি আন্দোলনের নামে যা হয় তা ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত লাভালাভের ইস্যুতে। এই কারণে আন্দোলনে থাকে নানা বিভক্তি। আর এখন শিক্ষক আন্দোলনের সৌন্দর্যও নষ্ট হয়ে গেছে।

সম্ভবত বখে যাওয়া ছাত্র-আন্দোলনের প্রভাবে বলপ্রয়োগ আন্দোলন সফল করার নিয়ামক মনে করছেন শিক্ষকগণও। দেখা যাচ্ছে ভিসি অফিসে ভিসি আর কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করে পাহারায় বসে থাকেন শিক্ষকরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতে দেখা গেছে ভিসিবিরোধী আন্দোলন থেকে ভবন দখল আন্দোলন পর্যন্ত সব সময় শ্রেণিকক্ষের সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদ করে প্রশাসনিক ভবন ঘেরাও করে দিন রাত পাহারায় বসে থেকেছেন শিক্ষকরা। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঢুকতে পারছেন না, কাজ করতে পারছেন না।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার কয়েক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধন করেছে। বিধানসভায় পাস হওয়া এই বিলে দুর্নীতি, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা এবং কাজে ব্যর্থতার দায়ে উপাচার্যকে অপসারণের সুযোগ রাখা হয়েছে। আমাদের সিনেট সিন্ডিকেটের মতো পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে কোর্ট কাউন্সিল। নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী এই কাউন্সিলে বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ বাতিল করে দেয়া হয়েছে। এর আগে একটি অধ্যাদেশ জারি করে বলা হয়েছে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির কারণে শিক্ষার মান কমে যাচ্ছে।

রাজনীতির থাবা আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষাকে যখন কঠিন সংকটে ফেলে দিয়েছে তখই প্রতিবেশী দেশের এমন সবল একটি পদক্ষেপ আমাদের আশাবাদী করে তোলে। এ ধারার পদক্ষেপ আমাদের নীতি নির্ধারকদের অনুপ্রাণিত করলে বন্দিদশা থেকে আমরা নিশ্চয় মুক্তি পাব। আমি যতদূর খবর রাখি তাতে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আমাদের মতো অতটা নষ্ট করে দেয়নি। তারপরও এ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সুশীল সমাজ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধতে পারছিলেন না কেউ। শেষ পর্যন্ত মমতা সরকার এই অসাধ্যটি সাধন করল।

আমি পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি সেখানে শিক্ষকদের মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শগত মতভেদ আছে, কিন্তু তার কারণে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করার মতো সংকট তারা সাধারণত সৃষ্টি করেন না। সেখানে মেধা বিচারের বদলে ভোটার শিক্ষক নিয়োগের প্রবণতা তেমন চোখে পড়ে না। অন্তত গত শতকের নব্বইয়ের দশকে কলকাতা শহরকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি থাকলেও ছাত্র সংঘাতের কথা তেমন শুনিনি। পরবর্তী দেড়যুগে বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিতে জাতীয় রাজনীতির কুপ্রভাব পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও পড়েছে তবে আমরা যতটা বখে গেছি তার সঙ্গে তুলনীয় নয়। তারপরও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন পশ্চিমবঙ্গের অভিভাবক ও সুশীল সমাজ। উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।

আমরা মনে করি জাতীয় রাজনীতির নষ্ট আদর্শের ঘেরাটোপে পড়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি অন্ধকার আবর্তে ঘুরছে। এ থেকে বের হতে হলে সৎ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিকল্প নেই। যদি আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকরা মনে করতে পারেন বিশ্ববিদ্যালয়ই জাতির মেধা-মনন ও মেরুদণ্ড নির্মাণের পীঠস্থান, তবে অবশ্যই একে দলীয় রাজনীতির ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত করতে হবে। রাজনীতির বিধায়করা সহজে এপথে হাঁটবেন মনে হয় না। তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। দেশের সব সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং নাগরিক সমাজকে দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।

ছাত্ররাজনীতিকে কলুষমুক্ত করতে হলে দলীয় রাজনীতির আসুরিক দাপট থেকে ক্যাম্পাসকে মুক্ত করতে হবে। ছাত্র সংসদ সক্রিয় হলে- নির্বাচিত ছাত্ররা ছাত্র প্রতিনিধি হতে পারলে গুণগত পরিবর্তন আসত ছাত্র রাজনীতির। রাজনৈতিক দৃষ্টিতে মেধার বদলে রাজনৈতিক কর্মীর সক্ষমতাকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ করতে হবে। সর্বোপরী দলীয় দৃষ্টিতে ভিসি থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে নিয়োগ বন্ধ করতে না পারলে কোনো শুভ উদ্যোগই সফল হবে না।

জানি বর্তমান রাজনৈতিক কাঠামোতে এসব বাস্তবায়ন অনেকটা স্বপ্ন কল্পনা। তারপরেও তো সময়ের প্রয়োজনে ঘুরে দাঁড়াতে হয়। দেশাত্মবোধ নিয়ে জাতির বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় আমরা কি অশুভ রাজনীতির বলয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্ত করার কথা ভাবতে পারি না?

লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এ বিভাগের আরো খবর