বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু। দুটি শব্দ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আজ সেই ঐতিহাসিক ১৭ মার্চ, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। অন্যদিকে তারই স্বপ্নের সোনার বাংলার স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরপূর্তি তথা সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব।
আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে মার্চ এক অনন্য সাধারণ মাস। ১৯৭১ সালের এ মাসেই আমাদের স্বাধীনতার সুস্পষ্ট ধারণা পেয়েছিল বাংলার মানুষ তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে। এই মার্চেই গণহত্যার ভয়াল স্মৃতি, বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের শুরু।
৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে অতঃপর বহুল আকাঙ্ক্ষিত সেই স্বাধীনতা এলো ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে। সেই ইতিহাস সবারই জানা।
আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উৎসব উদযাপনের প্রাক্কালে আমাদের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে হবে, তবেই হবে এই মহান নেতার প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রান্তনীতির মধ্যে দিয়ে হাজার মাইল দূরের বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অঙ্গীভূত করার সঙ্গে সঙ্গে সেদিনের যুবনেতা শেখ মুজিব বুঝেছিলেন এই স্বাধীনতা বাংলার মানুষকে মুক্তি দেবে না। তাই চল্লিশ সালে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনি স্বাধীনতার কণ্টকাকীর্ণ পথে যাত্রা শুরু করেন।
১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবির মধ্যে দিয়ে সেই স্বাধীনতার স্বপ্ন স্পষ্ট হয়ে প্রকাশ পায়। এর পরের ৪ বছরে দ্রুত অগ্নিগর্ভের দিকে ধাবিত হয় পূর্ব পাকিস্তান।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ কোনোদিন স্বাধীন রাষ্ট্র হতো কি না সন্দেহ আছে। তাই ১৭ মার্চ অসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। বঙ্গবন্ধুর জন্মের মধ্যে দিয়ে আসলে সেদিনই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বীজ রোপিত হয়।
কতটা দূরদর্শী হলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে এর পরিণাম উপলব্ধি করা সম্ভব, সত্যিই তা ভাববার বিষয়। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখি- বঙ্গবন্ধুর সসমসময়ের অনেক নেতা ছিলেন, তার অগ্রজ তথা বয়সে প্রবীণ বিখ্যাত নেতাও ছিলেন এবং পরেও জন্মেছিলেন। কিন্তু কেউই বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা কল্পনা করেননি। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের মাত্র ১০ দিনের মধ্যে কলকাতার বেকার হোস্টেলে তরুণ শেখ মুজিব ছাত্রদের উদ্দেশে বলেছিলেন, এই স্বাধীনতা বাংলার মানুষকে মুক্তি দেবে না।
বাঙালির কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার লক্ষ্যে সেই যে তিনি সংগ্রামের পথ বেছে নিলেন, সেই দু্র্গম পথচলা প্রবহমান থেকেছে তার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত । অর্থাৎ বাঙালির স্বাধীনতা যেমন তার কাঙ্ক্ষিত ছিল, তেমনই অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তিও তিনি চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন শোষণ ও বঞ্চনামুক্ত একটি উদার অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। সেই আকাঙ্ক্ষা থেকেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষকে এক প্ল্যাটফর্মে আনার জন্য প্রস্তুত করেছিলেন, কঠিন সংগ্রামের জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দীক্ষা দিয়েছিলেন। তার সেই দীর্ঘ সাধনার ফসল আমরা ঘরে তুলেছি একাত্তরের ডিসেম্বরে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী সাড়ে তিন বছরও তিনি দিনরাত ব্যস্ত ছিলেন এই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে সোনার বাংলারূপে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তুলতে। সে কাজ তিনি অনেকখানি করেও ফেলেছিলেন। বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে বাংলাদেশের জন্য স্বীকৃতি আদায়, সংবিধান প্রণয়ন, জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ওআইসিসহ বিশ্বসংস্থাসমূহের সদস্যপদ অর্জন, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য সার্বিক অবকাঠামো গঠন, পরিকল্পনা প্রণয়নসহ বহু কাজ তিনি ওই সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই সম্পন্ন করেছিলেন।
এটা সম্ভব হয়েছিল এই কারণে যে, ১৯৭১ সালেই তিনি স্বাধীন দেশের গঠন প্রক্রিয়ার রূপকার হননি, আরও অনেক আগেই তিনি স্বাধীন দেশের পরিচালনার নকশা করে রেখেছিলেন, কীভাবে সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়া হবে তার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা তার মনে ছিল। যে কারণে কপর্দকহীন অবস্থায় বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করলেও তিনি কিন্তু বেতবুনিয়ায় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র নির্মাণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনা করতে ভোলেননি। আণবিক শক্তি কমিশনকে একটি স্বাধীন দেশের উপযোগী করে গঠন করতে সামান্য দ্বিধা করেননি। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু সবকিছুই করেছিলেন। তার সুফল আজ আমরা ভোগ করছি।
আজকে যে বাংলাদেশের উন্নয়নের জোয়ার, তার সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ যে আজ অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করে চলেছে, মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের দরজায় পা রেখে বিশ্ববাসীর বিস্ময় হয়ে উঠেছে, এর সব কিছুরই রূপকার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ইতিহাস বিকৃত করে তাকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা হয়েছিল। ২১ বছরে (১৯৭৫-৯৬) কম করে হলেও দুটি প্রজন্ম একেবারেই অন্ধকারে থেকেছে আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে। মহানায়ককে উলটো ইতিহাসের খল চরিত্র বানানোর হীন চেষ্টা আমরা লক্ষ করেছি। কিন্তু ১৯৭৮ লেখা কবিতার প্রত্যয়ই শেষ পর্যন্ত সত্য হয়েছে।
স্বার্থে ওরা অন্ধ এখন যা খুশি তা বলবেই/ইতিহাসের সত্যাকাশে সূর্য মুজিব জ্বলবেই।
এই ভবিষ্যদ্বাণী সূর্যের মতো সত্য। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে জাতি গভীর শ্রদ্ধায় তাকে স্মরণ করছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত তার সংগ্রামী জীবনের ঘটনাগুলো আজ সমস্ত গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে আর মানুষ বিস্ময়ে আবিষ্কার করছে বঙ্গবন্ধুর জীবনের অনেক অজানা অধ্যায়।
বঙ্গবন্ধুর জীবনের খণ্ড খণ্ড চিত্র প্রতিদিন গণমাধ্যমে উপস্থাপনের মাধ্যমে জন্মশতবর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ‘বঙ্গবন্ধু প্রতিদিন’ শিরোনামে যে প্রতিবেদনটি গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে তা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশভাবনা তথা স্বাধীনতার জন্য কী চরম মূল্য তিনি দিয়েছিলেন, তার দালিলিক চিত্র পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারছি। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং পাকিস্তানি স্পেশাল ব্রাঞ্চের গোপন প্রতিবেদন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অপপ্রচারের সকল অন্ধকার চিরে ভোরের সোনালি সূর্যের মতো সত্যের আলোয় দেদীপ্যমান করে তুলছে আজ। এর সব কৃতিত্ব জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার। তিনি এসব গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি উদ্ধার তথা সংগ্রহ- সংরক্ষণ করে প্রকাশের মাধ্যমে ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে জাতির পিতাকে রক্ষা করেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসকে কলঙ্কের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। এসব গ্রন্থ ও বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন বক্তৃতার সংকলনের মধ্য দিয়ে আমরা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুকে যেমন জেনেছি, তেমনি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামমুখর ইতিহাসের সার্বিক একটা চিত্রও লাভ করেছি। একই সঙ্গে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছি এই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রকে তিনি সবদিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলবার জন্য কোন কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিলেন এবং কী কী পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের দেশ পরিচালনায় তিনি যেসব বক্তৃতা করেছেন সেসব বক্তৃতাও সেই মহৎ আকাঙ্ক্ষার চিত্রই উন্মোচন করে রেখেছে।
১৯৭৫ সালের স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে তিনি বলেছিলেন-
এই দিন থাকবে না। আমরা বাংলাদেশের মানুষ। আমাদের মাটি আছে, আমার সোনার বাংলা আছে, আমার পাট আছে, আমার গ্যাস আছে, আমার চা আছে, আমার ফরেস্ট আছে, আমার মাছ আছে, আমার লাইভস্টক আছে। যদি ডেভেলপ করতে পারি ইনশাআল্লাহ এ দিন থাকবে না।...
আজকে বিশ্ববাসীর বিস্ময়ে যে বাংলাদেশ তারা দেখে, সেটা তো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলারই বাস্তব রূপ। বঙ্গবন্ধু যদি ১৯৭৫ সালে নিহত না হতেন। অন্তত দশটা বছর তিনি বেঁচে থাকতেন, তাহলে এই বাংলাদেশ আজকের রূপ পেত ১৯৮৫ সালের মধ্যেই। বাঙালির দুর্ভাগ্য, জাতির পিতাকে রাষ্ট্রগঠন কাজে একটা দশকও পাওয়া গেল না! মাত্র ৫৫ বছরের একটা জীবন! সে জীবনে কত কী-ই না তিনি করে গেলেন! একটা পরাধীন জাতিকে শুধু একটি রাষ্ট্র দিয়ে যাননি; সেই রাষ্ট্র কেমন করে বিশ্ব দরবারে মর্যাদাবান জাতি হিসেবে টিকে থাকবে তার রূপরেখা তিনি তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন।
বাংলাদেশকে যে দুর্গত অবস্থা থেকে তিনি টেনে তুলছিলেন সেই ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা বিস্মিত হই। আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কারণে সেদিন স্বাধীনতাবিরোধীরাও পরাশক্তির সহচর হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা নস্যাৎ করে দিয়ে বাংলাদেশকে তারা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, করেছিল অপমান।
বিধির বিধান তাদেরই বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হচ্ছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বঙ্গবন্ধু সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিতে হিমশিম খেয়েছেন আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে চরম খাদ্যসংকট সৃষ্টি হয়েছে, গরিব মানুষ না খেয়ে মরেছে! আজ ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান দিয়েও আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ।
সব ষড়যন্ত্রের নাগপাশ ছিন্ন করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে নিয়ে দেখানো পথে তার সুযোগ্য কন্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা কেমন করে বাংলাদেশকে উন্নয়নের এমন উচ্চতর পর্যায়ে টেনে এনেছেন তা বিশ্ববাসীর কাছে এক বড় বিস্ময় ও কৌতূহল। খাদ্য আর স্বাস্থ্য পুষ্টি নিশ্চিত করে আমরা আজ খাদ্যে উদ্বৃত্ত।
শেখ হাসিনা তৃতীয় বিশ্বের এমন এক রাষ্ট্রনায়ক যিনি তার দেশকে শুধু উন্নয়নের রোল মডেল করেননি, ‘মাদার অব হিউমিনিটি’ সম্মাননা অর্জন করেছেন বিশ্বসংস্থার কাছ থেকে। এমন বহু আন্তর্জাতিক সম্মান তিনি অর্জন করেছেন।
স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ আর মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা উদযাপন করছি। এ শুভলগ্নে বলতে ইচ্ছে করে-
“সাবাস বাংলাদেশ ! এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়/ জ্বলেপুড়ে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।”
এত অর্জন আর গৌরবের পরেও আমরা কি সবাই গর্বিত? না সবাই গর্বিত নয়! যারা একাত্তরের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল মুক্তিযুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ বলেছিল তাদের অনুসারী এবং বংশধরেরা মোটেও গর্বিত নয়! তারা স্বাধীনতার ঘোষণাকে অস্বীকার করে! বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তারের ঘটনাকে তারা বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করে। জাতির পিতাকে তারা জাতির পিতা হিসেবে মেনে নেয়নি। ইতিহাসের ৭ মার্চ, গণহত্যার ২৫ মার্চ তাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে থাকে না।
তারা জাতির পিতাকে ইতিহাস থেকে আড়াল করে দিতে চেয়েছিল। এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’ শীর্ষক গ্রন্থমালা।
২০০১ সালে ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উদ্যোগে ২০০৪ সালে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’ সংশোধন করা হয়। দলিলপত্রের তৃতীয় খণ্ডের একটি অধ্যায় পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় নতুন সংস্করণ প্রকাশ করে, এটির কিরুদ্ধেই মূলত অভিযোগ ওঠে ইতিহাস বিকৃতির। যেখানে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তৎকালীন ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে যে মেসেজটিতে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা, সেই ঘোষণার মেসেজটি “তথ্যনির্ভর ছিল না” এমন হাস্যকর যুক্তি তুলে ধরে তার বদলে মেজর জিয়া ২৫ মার্চ মধ্যরাতে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বলে নতুন তথ্য দলিলপত্রে সংযোজন করা হয়। আর তার ২৭ মার্চে চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে পাঠ করা ঘোষণাকে উল্লেখ করা হয় দ্বিতীয় ঘোষণা হিসেবে।
এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র তৃতীয় খণ্ড থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার তথ্যটি বাদ দেয়া হয়!
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বদেশে ফিরে এসেছিলেন, তা আমাদের প্রজন্ম দেখেছে। আর ২০০৯ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধু প্রকৃত ইতিহাসের আলোতে ফিরে এলেন সেটি তরুণ প্রজন্ম দেখবার সুযোগ পেল, এটাই হচ্ছে সৌভাগ্যের কথা।
১৯৭৫ পরবর্তীকালের অন্তত দু-তিনটি প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে জানতেই পারেননি। তারা বিকৃত ইতিহাস জেনে বড় হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মতো অতুলনীয় দেশপ্রেমিকের আত্মত্যাগ আর স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আঁতুড়ঘরের কোনো ইতিহাসেই তারা জানতে পেল না। যে কারণে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, সংগ্রাম, আন্দোলন, সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা তথা বিজয় অর্জন, এরপর ৬ দফার আলোকে দেশ পরিচালনার অধিকার থেকে বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার প্রতিবাদে ১ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাংলার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ এবং ২৫ মার্চের গণহত্যা, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা এবং সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার প্রজন্ম বঞ্চিত হলো তারা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথ খুঁজে পাননি। পেয়েছেন সাম্প্রদায়িকতার পথ, পাকিস্তানি উগ্রবাদী রাজনীতির পথ।
সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে যেমন অসাধ্য সাধন করা যায়, তেমনই জাতি হিসেবে বিশ্বে বুক উঁচু করে দাঁড়ানো যায়। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু তা দেখিয়ে গেছেন। দেশকে ভালোবেসে একজন মানুষ কতখানি সাহস, নিষ্ঠা আর কষ্টের পথে পা বাড়াতে পারেন, দেশ আর দেশের মানুষের জন্য কতখানি চরম ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।
বঙ্গবন্ধু সেই অগণতান্ত্রিক পাকিস্তানের সামরিক শাসককেই বাধ্য করলেন ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন দিতে! জনগণের আস্থার ওপর নির্ভর করে বঙ্গবন্ধু জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে সম্মত হন, যা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন অনেক বাঘা রাজনীতিক!
বঙ্গবন্ধু সারা জীবন উদার মানবিক ঔদার্য আর ন্যায্যতা দ্বারা চালিত হয়েছিলেন। তার কিছুটা তুলনীয় হতে পারেন শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার মানবতাবাদী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা।
তিনি কতটা পরমতসহিষ্ণু ছিলেন একটি দৃষ্টান্ত দেয়া যাক। তিনি তখন জাতির পিতা, সমগ্র জাতির অস্তিত্বের প্রতীক। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ভূষিত জনপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু। তার সরকার এবং ব্যক্তিগতভাবেও তার সমালোচনামুখর এক তরুণ বিরোধীদলীয় সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। প্রতিদিন সমালোচনায় কাঁপাচ্ছেন সংসদ।
সরকার দলীয় সদস্যরা অনেকেই ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত। কিন্তু সংসদ নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিবিড় ধৈর্য সহকারে তরুণ বিরোধী সাংসদের বক্তব্য শুনতেন। বিটিভির সংবাদের সেই দৃশ্য আজ সংরক্ষিত বিটিভি আর্কাইভে!
বাংলাদেশ একজন শেখ মুজিবের জন্য কত কাল অপেক্ষা করেছে। রবীন্দ্রনাথ যে তার জীবনসায়াহ্নে ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন এক পরিত্রাণকর্তার কথা, তার আগমনের জন্য কবি অপেক্ষা করছিলেন, বলেছিলেন ‘তিনি পূর্ব দিগন্তে আবির্ভূত হবেন এবং বিচূর্ণ সভ্যতায় মানবিক মূল্যবোধে বাঙালিকে মনোনীত করে তুলবেন”। মনে হয় যেন বঙ্গবন্ধুর মতো এমন কোনো মহান বাঙালি নেতার কথাই কবির ভাবনায় ঠাঁই পেয়েছিল।
১৯২৬ সালে এস ওয়াজেদ আলীর ‘বাঙালির বাংলা’ প্রবন্ধেও দেখি ঠিক বঙ্গবন্ধুর মতো, বাঙালি জাতিকে মহিমান্বিত করার মতো কোনো নেতার আকাঙ্ক্ষা তার মনেও জেগেছে। তিনি লিখেছেন-
বাঙালি এখন সেই ভবিষ্যতের পূর্ণতার রাজনীতির জন্য প্রতীক্ষা করছে ...বাঙালি এখন সেই মহামানবের প্রতীক্ষায় আছে যিনি তাকে এই গৌরবময় জীবনের সন্ধান দেবেন...।
রবীন্দ্রনাথ, এস ওয়াজেদ আলী এই ভাবনা তো ভেবেছিলেন যে পূর্ববাংলায় এমন একজন কেউ আসবেন, যিনি বাঙালিকে মহিমান্বিত করবেন, মুক্তির আলোয় উদ্ভাসিত করবেন। বাঙ্গবন্ধুর জীবন আর কর্ম পর্যবেক্ষণ করলে মনে হয় সেই আত্মমর্যাদাবান ব্যক্তিটি আর কেউ নন, তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। আত্মমর্যাদা কাকে বলে তার একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেই লেখা শেষ করব।
দাতা মহল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে সহায়তা দিতে চাইল বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্ব সহায়তা দিতে চাইল, তবে একটি শর্ত এই যে, পাকিস্তানের ঋণের সুদের কিছু দায় বাংলাদেশকেও শোধ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু তখন পরিষ্কার বলে দিলেন, ‘এই যদি হয় আপনাদের শর্ত, তবে কোনো সাহায্যই আমরা নেব না।’
১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু তার জীবনের শেষ জনসভাও বলেছিলেন-
আমরা ভিক্ষুকের জাতি হিসেবে বাঁচতে চাই না।
তৃতীয় বিশ্বের যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন একটি দেশের সরকার প্রধানের কণ্ঠ থেকে সাম্রাজ্যবাদীরা এমন সাহসী বক্তব্য কল্পনাও করতে পারেনি। এমনই সাহসের নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে আমরা উদ্বেলিত। আমরা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠছি, বাংলাদেশ ইতিহাস চেতনায়ও সমৃদ্ধশালী হবে, তার গৌরবের ইতিহাস প্রজন্মের কাছে তুলে ধরবে, জাতির পিতার স্বপ্নসাধ পূরণ হবে।
লেখক : কবি, সাংবাদিক-কলাম লেখক, সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত।