মহিউদ্দিন হিমেল নামের এক তরুণ আমার ফেসবুকে মন্তব্য করে জানিয়ে দিলেন ১৪ ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী হত্যার সময় ঢাকা ভারতীয় সেনাবাহিনী ও আওয়ামী লীগের দখলে ছিল।
হিমেল একইসঙ্গে আফগানি নামের এক শিবির কর্মীর একটি লেখাও শেয়ার করেছেন। হিমেল বিশ্বাস করেন, যেসব বুদ্ধিজীবী হত্যার কথা আমরা বলছি তারা প্রত্যেকেই ছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর সমর্থনক এবং যেহেতু তারা মুক্তিযুদ্ধে না গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়সহ নিজ নিজ পেশায় যুক্ত ছিলেন ফলে তাদের পাকিস্তানিরা মারতে পারে না।
আমি মহিউদ্দিন হিমেলের ফেসবুকে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তার লেখা, তার করা মন্তব্য, তার পছন্দের প্যাটার্ন, তার রাজনৈতিক ভাবনাগুলো দেখলাম। হিমেলের বয়স খুব বেশি হলে ২৩ থেকে ২৭ এর মধ্যে হবে। তারুণ্যে ঝকঝকে একজন।
এমন একটা বয়স আমি নিজেও পেরিয়ে এসেছি এক যুগেরও বেশি আগে, কিন্তু আমি হিমেলের মতো করে ভাবিনি।
চট করে আমার মাথায় প্রশ্ন এলো, আমি কেন হিমেলের মত ভাবতে পারিনি বা আমি কেন ভিন্নভাবে ভেবেছি আর হিমেল কেন এভাবে ভাবছে?
একই দেশে আমরা জন্মেছি। একই দেশে আমরা বড় হয়ে উঠেছি, একই দেশ আমাদের দুজনকেই ধারণ করেছে, অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময়ের এমন বীভৎস হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আমাদের দুজনের ন্যারেটিভ এমন দুই প্রান্তের কেন?
আমাদের ভাবনার ভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু সেই ভিন্নতা এমন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ইস্যুতে এক না হলেও খুব কাছাকাছি ন্যারেটিভের হবে, এমনই এক্সপেক্টেড।
অথচ হিমেল ভাবছেন এমন এক আঙ্গিকে যেটির সঙ্গে এই ইস্যুতে হয়ে যাওয়া আদালতের রায়, শত শত ইতিহাস বই, এত এত প্রত্যক্ষ সাক্ষী, যারা খুন হলেন তাদের আপনজনের সাক্ষ্য- এর কোনো কিছুই হিমেলকে স্পর্শ করেনি।
তাহলে হিমেলকে স্পর্শ করেছে কাদের লেখা ইতিহাস?
আশ্চর্য হলেও সত্য, হিমেলকে স্পর্শ করেছে একজন শিবির কর্মীর লেখা একটা ব্লগ।
আমি হিমেলের উপর রেগে নেই, আমি হিমেলের উপর ক্রোধে আচ্ছন্ন নই কিন্তু আমার এক ধরনের বিপন্ন বিস্ময় যে রয়েছে, এটিতে একেবারেই সন্দেহ নেই।
সাত বছর আগে এই বুদ্ধিজীবী হত্যার উপর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ট্র্যাইবুনালের বেশ কয়েকটি রায় এসেছে। এই রায়গুলোকে শুধু রায় বললে খুব ভুল হবে। রায়ের পাশাপাশি ইতিহাসের মহামূল্যবান সব দলিল বিস্তারিতভাবে উঠে এসেছে এসব রায়ে।
শুধু দলিল আর দস্তাবেজ-ই নয় বরং এইসব দলিলের বিশদ আইনি ব্যখ্যা এসেছে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের বিচারকদের লিখিত বর্ণনায়। এক একটা রায় পড়ি আর বিচারকদের আইনি পর্যবেক্ষণে মুগ্ধ হই। আইনের এমন কোনো মারপ্যাঁচ নেই যেগুলো এসব মামলায় অভিযুক্তরা ব্যবহার করেনি।
দুই পক্ষই দেশের সবচেয়ে দক্ষ আইনজীবীদের নিয়োগ দিয়েছিল, দুই পক্ষই হায়েস্ট লেভেলের আইনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল। ফলে এর নির্যাস হিসেবে যা এসেছে সেগুলো আমাদের জাতীয় ইতিহাসে অসম্ভব রকমের গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন, এটি বলাটা বাহুল্য মাত্র।
যদি ধরেও নেই হিমেল এই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে একটি রাজনৈতিক আদালত বলে বিবেচনা করেন, তাহলে আমি এই আদালতের রায়কে আলোচনার স্বার্থে এই লেখায় দূরে রাখছি।
আদালতের রায়কে দূরে রেখে দিলেও এই রায়ে ভিকটিম পরিবারের বিস্তারিত সমস্ত সাক্ষীদের বর্ণনা উঠে এসেছে যেগুলো সিমপ্লি সাক্ষীদের বিশদ স্টেটমেন্ট। হিমেলের কাছে আমার জানতে ইচ্ছে করছে, এই সাক্ষ্যগুলো হিমেল কখনও পড়ে দেখেছেন কিনা?
সাক্ষীদের কেউ কোনোদিন দাবি করেননি যে, তাদের বাবা, তাদের ভাই, তাদের স্বামী, তাদের চাচা, মামা, খালু (সাক্ষীদের সঙ্গে যার যেমন সম্পর্ক, সেই সূত্রে) ভারতীয় সেনাবাহিনী কিংবা আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের হাতে খুন হয়েছেন। অন্ততপক্ষে আমি এই আদালতে আসা সাক্ষীদের বয়ানে সেসব পাইনি।
তাহলে ঠিক কোন যুক্তিতে হিমেল এমন একটা ঘটনার বর্ণনা করছে যে ঘটনা বাদীপক্ষের স্বজনেরাই কোনোদিন বলেননি কিংবা দাবিও করেননি?
এইসব মামলার বাদীপক্ষে এমন সব সাক্ষী আছেন যারা স্পস্ট বলেছেন, আমি হত্যাকারী আশরাফুজ্জামানকে নিজের চোখে আমার স্বজনকে নিয়ে যেতে দেখেছি, আমি চৌধুরী মইনুদ্দিনকে আমার স্বজনকে নিয়ে যেতে দেখেছি।
খোদ পাকিস্তানি সেনা অফিসার রাও ফরমান আলী নিজের লেখা বইতে এসব বুদ্ধিজীবী হত্যার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন, তাহলে হিমেল কেন অন্যরকম ভাবছেন?
এখানে মহিউদ্দিন হিমেলের জায়গায় বাংলাদেশের আরো অনেক তরুণ বা ব্যক্তিদের আপনারা বসিয়ে নিতে পারেন, যারা ঠিক হুবুহু একই রকম করে ভাবেন বা বলেন।
আমি যদি ধরে নেই হিমেল বা তার মতো আরো অনেকেই আমাদের আন্তর্জাতিক ট্র্যাইবুনালের উপর আস্থা রাখেন না, আমাদের ইতিহাসবিদদের প্রতি আস্থা রাখেন না, আমাদের কলামিস্টদের কলামের উপর আস্থা রাখেন না, আমাদের ব্লগারদের লেখার উপর আস্থা রাখেন না; তাহলেও আমার প্রশ্ন এসে যায়, তারা ঠিক কোন আশায় বা মোহে বা যুক্তিতে শিবির কর্মীদের লেখার উপর আস্থা রাখেন?
যেই শিবিরের পূর্ব নাম ছিল ছাত্রসঙ্ঘ, যেই শিবিরের ছেলেরা গঠন করে বানাল আল বদর, যেই শিবিরের ছেলেরা ঘরে ঘরে ঢুকে শিক্ষক, প্রফেশনালদের ধরে ধরে এনে বধ্যভূমিতে হত্যা করল- কী আছে তাদের লেখায়, যে লেখাগুলো মহিউদ্দিন হিমেলের মতো তরুণেরা বিশ্বাস করে বসলেন বা আস্থা রাখলেন?
কারো প্রতি আমার রাগ নেই। কারো প্রতি আমার ক্ষোভও নেই। কারো প্রতি আমার প্রতিশোধ নেবারও নেই আসলে। আমি জাস্ট বিস্মিত এবং কৌতূহলী, যে কেন মহিউদ্দিন হিমেলের মতো এই টগবগে তরুণেরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করে ভাবতে ভালোবাসে!
আমার প্রশ্ন এই একটাই-
কেন এমন হলো?
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী আইনজীবী, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট