বিশ্বের সব বইমেলায় সরাসরি বই বিক্রি হয় না। বইমেলার মুখ্য প্রেরণা ফ্রাঙ্কফুর্ট তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কাল বদলাচ্ছে, মন বদলাতে সময় নেবে। অনেক সময়ে অনেক বাধা সুযোগ হিসাবে আসে। প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে ছাপাখানার বিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বইপড়া, বইকেনা- বইয়ের যাবতীয় তথ্য ভার্চুয়াল মিডিয়ায় রূপান্তরিত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের মন পুরোপুরি সায় দিচ্ছে না।
শুনছি বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ এবার করোনাকালের ঝুঁকি বিবেচনা করে ভার্চুয়াল বইমেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমার মনে হয়, এটি বিবেচনাপ্রসূত সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হয়েছে। অনেকে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যুক্তি দেখাচ্ছেন, সকল কিছু খোলা আছে, বইমেলা কেন বন্ধ থাকবে। এ যুক্তি অনেকটা আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের লজিক্যাল ফ্যালাসি আকারে হাজির করা হচ্ছে, অন্যেরা করছে বলে আমরা কেন করব না!
অথচ আমরাই এতদিন অন্যদের অবিবেচনাপ্রসূত কার্যক্রমের সমালোচনা করে আসছিলাম। লেখক-সাহিত্যিকরা সমাজের সচেতন অংশ। তাদের দ্বারা এমন কোনো কার্যক্রম সংঘটিত হওয়া সমীচীন নয়, যেখানে সামান্যতম সামাজিক ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। এ কথা অস্বীকার না করা বোকামি হবে, এখনও বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির চরিত্র পুরোপুরি প্রকটিত নয়।
যেকোনো সময় এই ভাইরাসটি চরিত্র বদল করে আরও মারণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। ইউরোপ-আমেরিকায় রোগটি এরই মধ্যে গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণ শক্তিতে আঘাত করছে। এই সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র এক দিনে সর্বোচ্চ মুত্যুর সংখ্যা মোকাবিলা করেছে।
তবে আশার কথা, এই ভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা বাজারে আসতে শুরু করেছে। আমাদের দেশে এসে পৌঁছাতে হয়তো আরও কিছুটা সময় লাগবে। অতএব তীরে এসে তরী ডোবানোর মানে হয় না। বাঙালি জাতি ছোট স্বার্থ রক্ষায় কিছুটা বিশৃঙ্খল আচরণ করলেও বড় সংকট সংঘবদ্ধভাবে মোকাবিলা করার সামর্থ্য দেখিয়েছে সবসময়। এমনকি বর্তমান করোনাকালেও আমার মনে হয় এ জাতি যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে।
আবার যারা বলছেন সব কিছু ঠিকঠাক চলছে কিংবা অন্যরা ঠিকমতো মানছেন না, তাই বলে আপনি মানবেন না সেটা কেমন যুক্তি? আপনার স্বাস্থ্য, আপনার পরিবারের স্বাস্থ্য, আপনার মাধ্যমে একজন লোকও আক্রান্ত হোক, সেটি কাম্য হওয়া উচিত নয়। আর সবকিছু ঠিকমতো চলছে বলেও তো মনে হয় না। ঢাকা থেকে কমসে কম এক-তৃতীয়াংশ লোক করোনার কারণে বের হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে, যারা এখনো ঢুকতে পারছে না।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৫০ লাখ শিক্ষার্থী ঘরে বসে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের উৎসব বন্ধ আছে। অনেক লোক এখনও ঘর থেকে বেরোচ্ছে না। অনেক লোক আক্রান্ত হয়ে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
শীতের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি আরও অবনতি হচ্ছে। দেশের সব স্থানে সব ধরনের মেলার প্রতি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সেখানে প্রতিদিনের বাজার ব্যবস্থা খোলা থাকার সঙ্গে বইমেলা বাণিজ্যমেলার তুলনা করলে ভুল হবে।
নিশ্চয়ই অমর একুশে বইমেলা বাঙালি লেখক, পাঠক, প্রকাশকের প্রাণের মেলা। এর সঙ্গে আবেগ, ভালোবাসা প্রত্যাশা একাকার হয়ে আছে। সেদিক থেকে ভালো হয়, এখনই মেলা একবারে হবে না সিদ্ধান্ত না নিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি সাপেক্ষে ফেব্রুয়ারি শেষ সপ্তাহ থেকে স্বাধীনতার মাসের কিছুটা নিয়ে এক পক্ষব্যাপী করার প্রস্তুতি রাখা যায় কি না, ঝড়বৃষ্টির ঝুঁকি বিবেচনা করে।
সেই সঙ্গে ফেব্রুয়ারি শুরু থেকে যথারীতি ভার্চুয়াল মেলার সূচনা হতে পারে। এতে বড় ফায়দা হবে লেখক, প্রকাশক ও পাঠকের। ভবিষ্যতে এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও পরীক্ষণের কাজটি সম্পন্ন হতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মেলা হলে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি প্রকাশকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
ভার্চুয়াল বইমেলা রকমারি ডটকমসহ অনেকে করছে বলে বাংলা একাডেমির এ ধরনের উদ্যোগ গুরুত্বহীন হয়ে যাবে, এমন ভাবনার ভিত্তি নেই। ব্যক্তি বা একক কোনো প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ আর জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির সামগ্রিক উদ্যোগ এক করে দেখার সুযোগ নেই।
বর্তমান বইমেলাও ব্যক্তি বা একক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে শুরু হয়েছিল। এটি ছিল নিছক প্রকাশকদের উদ্যোগ। কিন্তু জাতির মননের প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি যুক্ত হওয়ায় জাতীয় ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। আমার ধারণা, বাংলা একাডেমির এই ভার্চুয়াল বইমেলা বইপড়া ও বই-পসারের ক্ষেত্রে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
লেখক: কবি, গবেষক ও সাংবাদিক