বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কিম কি-দুকের দৃশ্যকল্পের কাব্য

  •    
  • ১২ ডিসেম্বর, ২০২০ ২১:০৩

যে নৈতিকতার জায়গা থেকে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, সে নৈতিকতা তাকে চলমান অচলায়তন নিয়ে সমালোচনা করতে পিছপা করে না।

কিম কি-দুকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সর্বদাই একপাক্ষিক। যেহেতু তিনি ভিনদেশি নির্মাতা, তাই তার চিত্রায়িত ভাবনা আর দৃশ্যকল্পগুলোর সঙ্গে আমরা শুধু গ্রাহক হিসেবেই ভূমিকা পালন করি। তবু দৃশ্যকল্পের যেহেতু একটা বিশ্বজনীন উপযোগিতা আছে, তাই অন্যান্য অনেক বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারের মতো কিম কি-দুককেও আমরা পছন্দ করি। তার দৃশ্যের কাব্যময়তা আমাদের আপ্লুত করে। তাছাড়া তার দৃশ্যকল্পে যে বৌদ্ধ ধর্মীয় জীবনবোধ, সেটাও আমাদের মধ্যে বেশ মরমীবোধ তৈরি করে।

কিম কি-দুকের কাহিনির বুনন এবং নির্মাণ কৌশলে যেহেতু মোটামুটি রকমের দক্ষতা আছে, তাই তার প্রায় প্রত্যেকটি চলচ্চিত্রই বেশ চমকপ্রদ এবং আগ্রহজাগানিয়া। সম্প্রতি কোভিডজনিত অবরুদ্ধ সময়ের এক ঘটনায় কিম কি-দুকের কথা অনেক দিন পর মনে পড়েছিল।

স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার.... অ্যান্ড স্প্রিং চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

গত মধ্য জুনের ঘটনা। গুলশান ৮৯ নম্বর সড়কের এক আলিশান বাড়িতে জনৈক মাসুম ঢুকে পড়েছিলেন বাড়ি ফাঁকা দেখে। জনপ্রিয় নর্থ এন্ড কফির বিদেশি স্বত্বাধিকারী সেই বাড়িটির মালিক। তারা সে সময় দেশের বাইরে ছিলেন। তাদের অনুপস্থিতিতে শুধুমাত্র আরামদায়ক আশ্রয়ের জন্য জনৈক মাসুম সে বাড়িতে ঢুকে পড়েছিলেন। অননুমোদিত অনুপ্রবেশ যাকে বলে আর কি। পরে অনাকাঙ্ক্ষিত উপস্থিতি টের পেয়ে মাসুমকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

এই ঘটনা কিম কি-দুকের থ্রি-আয়রন চলচ্চিত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়। এই যে এক একটা সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রবণতার ছাপ আমরা কিম কি-দুকের ছবিতে দেখতে পাই, এটা তার ছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক।

কিম তার সময়কার দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজ ব্যবস্থাকে নানা আঙ্গিকে সমালোচনা করার চেষ্টা করেছেন। এজন্য দক্ষিণ কোরিয়ার মূলধারার চলচ্চিত্রে তিনি ছিলেন তার নির্মিত চরিত্রগুলোর মতোই না-ঘরকা না-ঘাটকা। চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ তার ছিল না। ১৫ বছর বয়সে স্কুল পালিয়েছেন। শিল্পকারখানায় কাজ করেছেন ২০ বছর বয়স পর্যন্ত। এরপরে কাজ করেছেন সামরিক বাহিনীতে। অর্থাৎ কিমের জীবন তাকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এক অভিজ্ঞতায় পূর্ণ করেছে। সেটার ছাপ আমরা তার ছবিতে দেখতে পাই।

থ্রি আয়রন চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

নব্বই দশকের প্রথম দিকে কিম প্যারিসে শিল্প বিষয়ক পড়াশোনা সেরে কোরিয়ায় ফিরে তার প্রথম ছবি ক্রকোডাইল নির্মাণ করেন। সেখানেই তার সমাজ সম্পর্কিত সমালোচনাগুলো ছবির পরতে পরতে উঠে আসতে শুরু করে। এরপরে তিনি আরও ২০টির মতো পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।

নিজের চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজ এবং তৎকালীন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে সমালোচনা করায় তিনি প্রথম থেকেই অধিকাংশজনের চক্ষুশূল ছিলেন। যতদূর মনে পড়ে, কোনো এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, তিনি ঠিক গড়পড়তা অর্থে নীতিপন্থি লোক নন। কিন্তু যে নৈতিকতার জায়গা থেকে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, সে নৈতিকতা তাকে চলমান অচলায়তন নিয়ে সমালোচনা করতে পিছপা করে না। তাছাড়া তার ধারণা, তিনি যথেষ্ঠ পরিচ্ছন্ন ছবি বানানোর ক্ষমতাও রাখেন। কিন্তু ততদিনে এত এত বিতর্কিত বিষয়ে তিনি ছবি বানিয়ে ফেলেছিলেন যে, পরিচ্ছন্ন ছবি বানালে লোকে তাকে টিটকারিও মারার সম্ভাবনা ছিল।

অ্যাড্রেস আননোন চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

সামাজিক সংস্কার নিয়ে সমালোচনার জন্য তার ছবিকে অনেকে বাহবা দিলেও, অনেকের কাছে তার ছবি বিদ্বেষমূলক এবং অসূয়াপ্রধান। দক্ষিণ কোরিয়ার বাইরে তিনি তার ছবির একটা বিশ্বজনীন আবহের জন্য প্রশংসিত, কারণ বিশ্বের দর্শকের কাছে দক্ষিণ কোরিয়ার আন্তঃসামাজিক দ্বন্দ্বগুলো হয়তো ছবির মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয়নি।

বিশ্ব দর্শকের কাছে, বিশেষত ভেনিস ও কান চলচ্চিত্র উৎসবে, কিম সমাদৃত তার অথর-প্রধান নির্মাণশৈলীর জন্য।

যেহেতু অনেক দিন কিম কি-দুকের ছবি দেখিনি, তাই যতদূর মনে পড়ে, তার ছবির চরিত্রগুলো খুব একটা সুনাগরিক নন। অধিকাংশ চরিত্রই অনৈতিক এবং আইন বহির্ভূত কাজের সঙ্গে জড়িত। ফলে জীবনের ক্রুর বাস্তবতাগুলো চাঁচাছোলাভাবে তার চলচ্চিত্রে ফুটে উঠে।

যেহেতু কিম শিল্পকলায় পড়াশোনা করেছেন, তাই তার ছবি দৃশ্যগতভাবে কাব্যিক হয়ে ওঠার একটা ব্যাপার আছে। এর ফলে ক্রুর বাস্তবতা অনেক সময় দৃশ্যগত কাব্যিকতা দ্বারা নমনীয় হয়ে যায়। এটা কারো কারো ভাল লাগে; কারো কারো লাগে না। যেমন, স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার... অ্যান্ড স্প্রিং ছবিটি কিম কি-দুকের অপেক্ষাকৃত দুর্বল চলচ্চিত্র বলে মনে হয় আমার। কেন মনে হয়, সে আলাপ এখানে করতে চাই না। সে জন্য আলাদা লেখা লিখতে হবে।

যতদূর মনে পড়ে, কিম কি-দুকের ব্যাড গাই, পিয়েতা, থ্রি-আয়রন, টাইম, দ্য কোস্টগার্ড, ড্রিম, বার্ডকেইজ ইন, ওয়াইল্ড এনিমলস এবং অ্যাড্রেস আননৌন চলচ্চিত্রগুলো বেশ ভাল লেগেছিল আমার। বিশেষ ভাল লেগেছিল, তাঁর আরিরাঙ ছবিটি। ছবিটি আত্মমগ্ন আর গ্লানিময়তার এক নৈব্যক্তিক উপলব্ধির ছবি। এই ছবিটি মূলত তার ড্রিম নামক আরেকটি ছবি নিমার্ণকালীন অভিজ্ঞতার উপর নির্মিত প্রামাণ্যধর্মী ছবি। ছবিতে নায়িকা আত্মহত্যার দৃশ্যে অভিনয় করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে যায়। সেই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিমের মনস্তাপ আরিরাঙ ছবিতে দারুণ উপলব্ধিতে দৃশ্যায়িত হয়েছে।

কিম কি-দুকের আচমকা মৃত্যুর খবরে কলেজ বন্ধুদের সাথে তার ছবিগুলো দেখার স্মৃতি মনে পড়ে গেল। কয়েক বছর আগে, ‘মি-টু’ আন্দোলনের সময়ে কিম কি-দুকের বিরুদ্ধে নারী সহকর্মীকে অবমাননার অভিযোগ উঠেছিল। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক ছিল। এর কোনো সুরাহা হয়েছিল কিনা জানি না। কিম কি-দুকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, তার চলচ্চিত্রকে আপনি চাইলেও অগ্রাহ্য করতে পারবেন না। তার চলচ্চিত্র দর্শককে প্রশ্নাতুর করে তোলে।

লেখক: চিত্রনাট্যকার

এ বিভাগের আরো খবর