নাটোরের তরমুজ চাষিদেরকে বেপারিরা বলেন, ঢাকায় ফলটির দাম অনেক কম। তাই তারাও টাকা কম দেবেন। আর পাইকাররা একজোট হয়ে দাম কম বলার কারণে কৃষক ক্ষতির মুখে।
গ্রীষ্মের রসাল ফল তরমুজ নিয়ে এবার যে আলোচনা, তা এর আগে কখনও হয়নি। রোজার শুরু থেকে ফলটির দাম ধাপে ধাপে বাড়তে থাকায় এক পর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতকে অভিযানও চালাতে হয়েছে।
রোজার আগে যে ফলের দাম ছিল কেজিপ্রতি ২০ থেকে ২৫ টাকা, সেটি এক পর্যায়ে ৫০ থেকে ৬০, পরে ৭০ টাকাও ছাড়িয়ে যায়।
ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান শুরু করলে জানা যায় আরেক ফাঁকি। বিক্রেতারা পাইকারিতে ফলটি কিনে আনেন শ হিসেবে, কিন্তু ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন কেজি হিসেবে। এটি কৃষি বিপণন আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
কেবল তাই নয়, পাইকারিতে শ হিসেবে কিনলে তরমুজের দাম কেজিতে পড়ে ১৫ থেকে ২০ টাকা। খরচ ও অপচয় ধরলেও তা ২০ থেকে ২৫ টাকার বেশি হয় না। আইন অনুযায়ী ফলে কেজিপ্রতি লাভ করা যায় ১০ টাকা। আর তরমুজের ক্ষেত্রে সেটি ৩ থেকে ৫ টাকা বলা আছে। এই হিসেবে বিক্রেতারা ঠকাচ্ছেন ক্রেতাদেরকে। তারা অনুমোদিত হারের কয়েক গুণ বেশি মুনাফা করছেন।
কিন্তু বাজারে এত দাম হলেও তাতে কৃষকদের কিছু যায় আসে না।
কিন্তু নাটোরের কৃষকরা জানাচ্ছেন, বেপারিরা তাদেরকে বলছেন, ঢাকায় তরমুজের দাম অনেক কম।
এই জেলার গুরুদাসপুর উপজেলার চরকাদহ এলাকাসহ চলনবিল জুড়েই শতশত হেক্টর জমিতে চাষাবাদ করা হয়েছে তরমুজ। এসব তরমুজের ওজন সর্বনিম্ন ৪ থেকে সর্বোচ্চ ১৬ কেজি পর্যন্ত।
গত সপ্তাহে কৃষকরা শ হিসেবে হিসাব ধরে ১৫ থেকে ২৩ হাজার টাকা পর্যন্ত জমিতেই বিক্রি করেন তরমুজ।
অথচ এক সপ্তাহের ব্যবধানেই দাম কমেছে অর্ধেকের নিচে। প্রতি শ তরমুজ এখন ১০ হাজার টাকার নিচেও। অর্থাৎ একেকটির দাম পড়ে ১০০ টাকা।
আবার বিট কাভার পদ্ধতির মাধ্যমে বিঘা ধরে জমির তরমুজ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন এখানকার কৃষক।
চলনবিল এলাকার চরকাদহ গ্রামের আশরাফুল ইসলাম দুই বিঘা জমিতে চাষ করেছেন এশিয়ান-টু (বাংলালিংক নামে পরিচিত) জাতের তরমুজ। খরচ হয়েছে এক লাখ ২০ হাজার টাকা।
শুক্রবার প্রতি ১০০ তরমুজ ১৮ হাজার টাকা দরে বিক্রি করেন তিনি। সঙ্গে বিনামূল্যে দিয়েছেন পাঁচটি তরমুজ।
জমিতে বিক্রি উপযোগী পাঁচ শতাধিক তরমুজ থাকলেও পাইকারের দেখা না মেলায় জমিতেই তা নষ্ট হওয়ার উপক্রম।
আশরাফুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হেদিন (সেদিন-শুক্রবার) বেচনো (বেচা) আঠারো হাজার টেহা শও (শত)। আজ বেচাহালামু (বিক্রি); কিন্তু একটা পার্টিও (ক্রেতা) নাই। বেইচতে পারতিছিনা; কয় ৭ হাজার; ৬ হাজার টেহা শও-নি। এহন তাও নিচ্ছে না নি।’
তিনি বলেন, ‘দুই বিঘা জমি আবাদ করিছি (করা)। এক লাখ ২০ হাজার টেহা খরচ পড়িছি। বেচিছি (বিক্রি) ১৮ হাজার।। এহন (এখন) কোন পার্টিই তরমুজ লিচ্ছে (নেয়া) না কো। এহন গোটাটাই (সমস্ত) তো আমোরে (আমাদের) লচ।’
পাইকারি ব্যবসায়ী না পেলে তরমুজ কীভাবে বিক্রি করবেন?
এমন প্রশ্নের জবাবে আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘এই তরমুজ এহন কী করমু; জমিতেই পঁচি (নষ্ট) যাবি। আর না হয় গরু-বাছুর দিই (দিয়ে) খওয়াইলাগবি। তাছাড়া তো বুদ্ধি নাই কো।’
তার পাশে সাত বিঘা জমিতে ফলটির চাষ করেছেন তিন ভাই ফরিদুল ইসলাম, আনারুল ইসলাম ও সাইফুল ইসলাম। আনারুল ১৫ হাজার ও সাইফুল ১৭ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করেছেন। তারাও পাইকার পাচ্ছেন না।
আবু তালেব মিয়া দেড় বিঘা জমিতে চাষ করেছেন ৮০ হাজার টাকা খরচ করে। কিন্তু তরমুজ বিক্রির উপযোগী হওয়ার পর তিনি ভুগছেন হতাশায়।
তিনদিন ধরে পাইকারের দেখা পাচ্ছেন না। পরে এক হাজার ১৫০ তরমুজ একসঙ্গে বিক্রি করে দেন ৬০ হাজার টাকায়।
এতে করে প্রতি পিস তরমুজ এই কৃষক বিক্রি করেন মাত্র ৫২ টাকায়। আর এই উৎপাদিত তরমুজ তিন থেকে ১৪ কেজি পর্যন্ত ফলন দেয়। যার গড় ওজন ছিল ৫ কেজি। তাহলে প্রতি পিস তরমুজ ৫২ টাকায় বিক্রি হলে তা কেজিতে দাঁড়ায় সাড়ে ১০ টাকা।
আবু তালেব মিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার জমির তরমুজ বিক্রি হচ্চি না। কিন্তু খরচ করছি প্রচুর টেহা (টাকা)। এহন (এখন) বিচা (বিক্রি) না হওয়ায় সব একিবারে (এক সঙ্গে) বিচ্চি (বিক্রয়) ৬০ হাজার টেহায়। খরচ হলি (হয়েছে) ৮০ হাজার টেহা; বিচ্চি ৬০ হাজারত। তাইলে বউ-ছোল খাইটা (পরিশ্রম) তরমুজ বইয়ে (চাষ) কী হলি? তালি (তাহলে) কয় টেহা করি পড়িছে। কৃষক হামরা তালি পরি বাঁচি কিবা কইরে।’
আরেক চাষি আরিফুল ইসলাম বলেন, 'দেড় লাক (লাখ) টেহা (টাকা) খরচ হচি (হওয়া) তিন বিঘে জমিত। এহন ঢাকা বলতিচে দাম কম। বিধায় হেটি আমাগড়ে (আমাদের) বিঘে (বিঘা) ধরি (ধরে) ৮ হাজার, ৫ হাজার টেহাও দাম কচ্ছি।’
তিনি বলেন, 'এহনও খরচি (খরচ) তোলতি (উঠানো) পারি নাই কো। লচে (ক্ষতি) আছি এক লাক (লাখ) টেহা। কালি (গতকাল) বিচ্ছি (বিক্রয়) ৯ হাজার টেহা শও। আজ ফির কচ্ছি শও হবেরলয় (হবে না); বিট কাভার। হামাগকে ওরা দাম দিচ্ছি না কো তরমুজের।'
বাধ্য হয়েই এসব কৃষক জমি থেকে তরমুজ তুলে পথে-ঘাটে পিস হিসেবে বিক্রি করছেন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে নাটোর-পাবনা আঞ্চলিক মহাসড়কের গুরুদাসপুর উপজেলার ধারাবারিসা এলাকায় সড়কের পাশে পিস হিসেবে তরমুজ বিক্রি করছিলেন সিধুলি গ্রামের সেন্টু মিয়া।
তিনি বলেন, 'কয়েকদিন ধরে তরমুজের পাইকার নেই। বিঘা প্রতি তরমুজের দাম উঠছে মাত্র ১৫ হাজারে। যা খরচের তিনগুণেরও কম।
'ছোট ভাই করিছে দেড় বিঘে। আমার বড় ভাই করিছে এক বিঘে। এমনিভাবে আমরাই পাঁচ বিঘে জমিতে তরমুজ করিছি। কিন্তু পাইকারি খরিদার নাই। জমিতেই নামে না। যার কারণে অল্প কিছু তুলি; রোডে লিয়েআইসে এই যে বেচ্চি।'
চলনবিলসহ এই জেলার উর্বল মাটিতে এশিয়ান-২ (বাংলালিংক), বিগ ফ্যামিলি, ব্লাক সুইট, থাইল্যান্ড-টু, মিঠাল সুইট ও কালো জাম্পুসহ বেশ কয়েকটি জাতের দেশি-বিদেশি তরমুজ চাষ করা হয়।
এ বছরের জানুয়ারিতে শীষ্মকালীন এই ফলের বীজ বপনের চার মাস পর ফলন আসে এপ্রিলে। ভালো ফলনে কৃষকরা আর্থিক দৈন্যদশা কাটিয়ে উঠতে তাই আগাম তরমুজ চাষ করেছিলেন। কিন্তু প্রথম দিকে অল্প সংখ্যক কৃষক লাভের মুখ দেখলেও বর্তমানে সংখ্যাগরিষ্ঠরাই ক্ষতির মুখে।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুব্রত কুমার সরকার জানান, চলতি মৌসুমে জেলায় ৮৬৮ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৬ হাজার ৪৫৬ মেট্রিক টন।
তরমুজের বড় দরপতন ও মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেট সম্পর্কে সুব্রত কুমার সরকার বলেন, 'ইতোমধ্যে গত ২ মে থেকে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে তরমুজ সংগ্রহের পর বিক্রি কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেট ভেঙে কৃষক ও ভোক্তা পর্যায়ে তরমুজের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতেই এমন উদ্যোগ নেয়া হয়।'
আরও পড়ুন:চলমান তাপপ্রবাহে চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রধান অর্থকরী ফসল আমের গুটি ঝরে পড়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন আম বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা। এমনিতেই এ বছর মুকুল এসেছিল কম, গাছে যে কয়টা আমের গুটি টিকে আছে, তাপদাহের প্রভাবে সেগুলোর বৃদ্ধিও ঠিকমত হচ্ছে না বলে দাবি বাগান মালিকদের। এরই মধ্যে রোদের তাপে শুকিয়ে সেগুলো ঝরে পড়তে শুরু করেছে।
আমের গুটি যাতে শুকিয়ে না যায়, তার জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে, তাপদাহ থেকে আমের গুটি বাঁচাতে গাছের গোড়ায় নিয়মিত পানি সেচ দিতে হবে; প্রয়োজনে গাছে পানি স্প্রে করার পরামর্শও তাদের।
‘আমের রাজধানী’ খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জে এবার কিছুটা দেরিতেই এসেছিল মুকুল। পরিমাণেও ছিল অন্য বছরের তুলনায় বেশ কম। তারপরও শুরু থেকেই বাড়তি যত্নে বাগানগুলোতে মুকুল থেকে আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে আম। তবে কয়েক দিনের তীব্র তাপপ্রবাহ ভীষণ শঙ্কায় ফেলেছে বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীদের। গাছে থাকা আমের গুটির বৃদ্ধি ও টিকে থাকা নিয়ে তারা পড়েছেন দুশ্চিন্তায়।
জেলার মহারাজপুর এলাকার আম বাগান মালিক রাজন ইসলাম বলেন, ‘খরার কারণে আমের গুটির বড় হচ্ছে না, বোটা শুকিয়ে ঝরে পড়ছে। আকাশের পানি না হলে হয়? সেচ দিয়াও খুব বেশি কাজ হচ্ছে না, শ্যালো (সেচ পাম্প) যতক্ষণ চলছে ততক্ষন পানি থাকছে। বন্ধ করলেই সব তিলিকে (দ্রুত) শুষে লিছে (নিচ্ছে)।’
আম সংগঠনের নেতারাও বলছেন একই কথা। এ বছরের শুরু থেকেই বৈরী আবহাওয়ার কারণে তারা আমের কাঙ্ক্ষিত ফলন নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। চলমান তাপপ্রবাহ তাদের সেই দুশ্চিন্তাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের আম ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব আহসান হাবিব নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এমনিতেই এ বছর শীতের কারণে মুকুল আসতে দেরি হয়েছে, তার ওপর মার্চ মাসে অসময়ের বৃষ্টিতে একবার মুকুল ঝরে যায়।
‘তখন বৃষ্টির দরকার ছিলো না, তাই বৃষ্টির কারণে মুকুলের ক্ষতি হয়েছিল, আর এখন বৃষ্টির অভাবে গাছে যে কয়টা আমের গুটি ছিল, তাও ঝরে যাচ্ছে। তাপপ্রবাহ আরও কিছুদিন চললে ব্যবসায়ীদের আরও ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এমনিতেই এ বছর আম উৎপাদনের খরচ সব ক্ষেত্রেই বেড়ে গেছে। আবার এখন সেচ দেয়ার জন্য অনেকের খরচ আরও বাড়ছে। সবমিলিয়ে এ বছর খুব বেশি স্বস্তিতে নেই আম বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা। অনেকেই আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন।’
তবে এখনই আশাহত না হয়ে বাগানের সঠিক পরিচর্যা চালিয়ে যাওয়া ও তাপপ্রবাহ যতদিন চলবে ততদিন পর্যন্ত বাগানে সেচ দেয়া, তাপমাত্রা আরও বাড়লে সকালে বা বিকেলে গাছে সরাসারি পানি স্প্রে করার পরামর্শ দিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মোখলেসুর রহমান।
বাগান মালিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জের বড় গাছগুলোতে এবার মুকুল কম এসেছে, তবে ছোট গাছে ভালো মুকুল আছে। সঠিকভাবে পরিচর্যা করা গেলে কৃষি বিভাগ যে সাড়ে চার লাখ টন আমের উৎপাদন লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছে, তার কাছাকাছি অন্তত যাওয়া যাবে বলে আশা করছি আমরা।’
আরও পড়ুন:কুমিল্লা কৃষি বিভাগের উদ্যোগে জেলায় শুরু হয়েছে আনারসের ফিলিপাইনের একটি জাত।
এ উদ্যোগে যুক্ত একজন কৃষি কর্মকর্তা জাতটির বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, এ বছর আনারস চাষ সফল হলে আগামী বছর আরও বড় পরিসরে এ জাতের চাষ করা হবে।
রোপণ করা চারা থেকে আগামী মাস ছয়েকের মধ্যে ফলন পাওয়া যাবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভাষ্য, বিদেশি আনারসের এ জাতটির নাম এমডি-২। এটির আদি নিবাস ফিলিপাইন। এর আগে বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলায় এ জাতের আনারস চাষ হয়েছে। এ আনারসের চামড়া পাতলা ও প্রচুর ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে।
অধিদপ্তরের কুমিল্লা কার্যালয়ের উপপরিচালক আইয়ুব মাহমুদ বলেন, ‘এমডি-২ জাতের আনারসের আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক সুনাম আছে। বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকায় বেশ জনপ্রিয়। এ জাতের আনারস দেশীয় আনারসের তুলনায় অনেক বেশি মিষ্টি।
‘এ আনারস দ্রুত পচে না। প্রথমবারের মতো এ বছর আমরা পুরো কুমিল্লা জেলায় দেড় হাজার চারা বিতরণ করেছি। জেলায় আদর্শ সদর, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, সদর দক্ষিণ ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় বেশ কিছু টিলা ও পাহাড় রয়েছে। ছাড়াও লালমাই পাহাড়কে টার্গেট করে আমরা চারা বিতরণ করেছি। আশা করছি কুমিল্লার মাটি ও আবহাওয়া এমডি ২ জাতের আনারস চাষে বেশ উপযোগী হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ফলন ভালো পাওয়া যাবে। এ বছর আমরা সফল হলে আমাদের আগামী বছরে আরও ব্যাপকভাবে এমডি-২ জাতের আনারস চাষ করার পরিকল্পনা রয়েছে।’
হাওরবাসীর জন্য সবচেয়ে বড় আতঙ্ক অতিবৃষ্টি আর আকষ্মিক বন্যা। প্রতিবছর বৈশাখ আসার আগেই পাহাড়ি ঢল আর বন্যার আতঙ্কে থাকেন এই অঞ্চলের কৃষকরা। ফসল রক্ষায় অনেক সময়ই অপরিপক্ব ধান গাছে কাস্তে চালাতে হয় তাদের।
চলতি মৌসুমে হাওরের লাখ লাখ হেক্টর জমিতে সবুজ ধানের গালিচায় সোনালী রং ধরে গেছে। আর সে সুবাদে বৈশাখের শুরুতেই কৃষকরা ধান কাটতে নেমে পড়েছেন হাওরে। প্রকৃতি প্রতিকূল হয়ে ওঠার আগেই পুরো ফসল ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা।
সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলার ১৩৭টি হাওরে এক ফসলি বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলন দেখে বেজায় খুশি কৃষকরা। তারা আশা করছেন, অনুকূল আবহাওয়ার সুবাদে এবার তারা শতভাগ ধান গোলায় তুলতে পারবেন।
কৃষি অফিস বলছে, চলতি মৌসুমে সুনামগঞ্জের হাওরে ১০ লাখ কৃষক বোরো ধানের আবাদ করেছেন। অন্য বছরের তুলনায় এ বছর ফলন ভালো। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এবার সুনামগঞ্জে ২৬২ হেক্টর বেশি জমিতে ধান উৎপাদন হয়েছে। ধানগুলো বর্তমানে হাওরে কাচা-পাকা অবস্থায় রয়েছে।
তাহিরপুর উপজেলার বরদল গ্রামের কৃষক মন্তাজ মিয়া বলেন, ‘আমি বিআর-৯২ ধান লাগিয়েছিলাম। মাঝামাঝি সময়ে কিছুটা পানির সংকট ছিল। তবে এতে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। ফলন ভালো হয়েছে। আর চার থেকে পাঁচ দিন আবহাওয়া ভালো থাকলে আমার জমির ধান কাটা শেষ করতে পারব।’
সুনামগঞ্জ সদরের গৌরারং ইউনিয়নের কৃষক আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘ধানের ফলন ভালো হয়েছে। মাঠে ধান এখন পাকা ও আধপাকা অবস্থায় রয়েছে। এই সময়ে শিলাবৃষ্টি হলে আমরা মারা পড়বো। আশা করছি আনন্দের সঙ্গেই আমরা সব ধান ঘরে তুলতে পারব।’
শাল্লা উপজেলার আঙ্গারুয়া গ্রামের কৃষক আজমান গণি বলেন, ‘সঠিক সময়ে হারভেস্টার মেশিন ও ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া গেলে ফসল কাটা ও মাড়াই সহজ হবে। শিলাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, আকস্মিক বন্যা না হলে খুশি মনে ধান কাটা যাবে। কোনো ধরনের সমস্যা ছাড়া সঠিক সময়ে ঘরে ধান উঠাতে পারাটা আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, ‘আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আগামী ৫ মে’র মধ্যে হাওরের শতভাগ ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে। আমাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা পরামর্শের জন্য কৃষকদের পাশে রয়েছেন। হারভেস্টার মেশিনগুলো প্রস্তুত রয়েছে।
‘সুনামগঞ্জ জেলায় এ বছর বোরো ধান আবাদের লক্ষমাত্রা ছিলো ২ লাখ ২৩ হাজার ২৪৫ হেক্টর। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে অর্জন হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৪০৭ হেক্টর।’
তিনি আরও বলেন, ‘এবার ৯ লাখ ১৩ হাজার ৪০০ টন চাল উৎপাদনের লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে, যার বাজার মূল্য ৪ হাজার ১১০ কোটি টাকা।’
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের মধ্যে কৃষি খাতে গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে তিন বছরে কৃষি উন্নয়নে ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে বাংলাদেশ সরকার।
‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি (২০২৩-২৪ থেকে ২০২৫-২৬)’ অনুসারে, এই বিনিয়োগ খাদ্য নিরাপত্তা ও ন্যায়সঙ্গত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে কৃষির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ওপর জোর দেয়। সূত্র: ইউএনবি
জিডিপিতে হ্রাস প্রবণতা সত্ত্বেও এটি বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলে কৃষিনির্ভর সংখ্যাগরিষ্ঠদের জীবিকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্য উৎপাদন ও প্রতিকূলতা মোকাবিলায় সক্ষমতা বাড়াতে সরকারের গৃহীত কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে- উচ্চফলনশীল ও প্রতিকূলতাসহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবন, যান্ত্রিকীকরণ-সেচ সম্প্রসারণ এবং বীজ ও সারের মতো সাশ্রয়ী মূল্যের উপকরণের প্রাপ্যতা বাড়ানো।
নীতি নথিতে প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষির আধুনিকায়নের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- সম্পদ সংরক্ষণের জন্য সেচের জন্য ভূপৃষ্ঠের পানির ব্যবহার বাড়ানো, নবায়ণযোগ্য জ্বালানি সমাধানগুলো অন্তর্ভুক্ত করা এবং ফসল পরিচর্যার জন্য রিমোট সেন্সিং নিয়োগ করা।
সরকার একটি টেকসই ও স্বনির্ভর কৃষি কাঠামো গড়ে তুলতে ভর্তুকি, আর্থিক প্রণোদনা এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে এই খাতকে সহায়তা অব্যাহত রেখেছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের উপখাত থেকেও উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। এটি কেবল জিডিপি যথাক্রমে ২ দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং ১ দশমিক ৯১ শতাংশই বৃদ্ধি করে না, বরং জনসংখ্যার ১২ শতাংশেরও বেশি মানুষের প্রয়োজনীয় প্রোটিনের উৎস হিসেবে কাজ করে এবং জীবিকার সংস্থান করে। এই ক্ষেত্রগুলোর অর্জনের মধ্যে মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের আশা করা হচ্ছে। তাছাড়া রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের জন্য এসব খাত অত্যাবশ্যক।
ভবিষ্যতে এসব খাতের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি, উন্নত ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি গ্রহণ এবং সংরক্ষণ প্রক্রিয়া উন্নত করার জন্য বিশেষ করে ছোট ইলিশের (জাটকা) জন্য উন্নয়ন প্রকল্প চালু করতে প্রস্তুত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
টেকসই কৃষির গুরুত্ব বিবেচনায় পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা আরেকটি মৌলিক ক্ষেত্র। আন্তঃসীমান্ত নদী থেকে ন্যায়সঙ্গত পানির হিস্যা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জলাশয় খনন ও উপকূলীয় বনায়ন বৃদ্ধির মাধ্যমে ভূ-উপরিস্থ পানির প্রাপ্যতা উন্নয়নের উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ক্ষতির হুমকির মধ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপিতে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হ্রাসের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। সরকার এই প্রভাবগুলো হ্রাস করার বিস্তৃত কৌশলগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনাটি জলবায়ু সম্পর্কিত বাধাগুলোর বিরুদ্ধে সহনশীলতা এবং স্থিতিশীলতা বাড়ানোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ খাত ও সম্প্রদায়গুলোকে সরঞ্জাম দিয়ে প্রস্তুত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
এই বহুমুখী প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশের কৃষি ঐতিহ্যকে কেবল সুরক্ষাই নয়, বরং এগিয়ে নিতেও সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে।
মাগুরা জেলায় জনপ্রিয় হচ্ছে চিয়া সিডের চাষ। স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের খাবার তালিকায় চিয়া সিড এখন বেশ জনপ্রিয়।
চিয়া সিড মূলত মরুভূমিতে জন্মানো সালভিয়া উদ্ভিদের বীজ। মধ্য আমেরিকায় অনেক বেশি পাওয়া যায় এ শস্য। এটি সাধারণত শস্যের তালিকায় পড়লেও একে এক ধরনের ভেষজও বলা হয়।
চিয়া সিড দেখতে অনেকটা তিলের দানার মতো। পৃথিবীর পুষ্টিকর খাবারগুলোর মধ্যে চিয়া সিড অন্যতম। চিয়া সিডে আছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডম কোয়েরসেটিন, কেম্পফেরল, ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড ও ক্যাফিক এসিড নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন ক্যালসিয়াম এবং দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয় খাদ্য আঁশ, যা মানব দেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এটি স্বাস্থ্যের জন্য যেমন উপকারী, তেমনি ফসল হিসেবেও লাভজনক।
মাগুরা সদর উপজেলার নালিয়ারডাঙ্গি গ্রামের প্রতিবন্ধী কৃষক আক্কাস আলী শুরু করেন চিয়া সিডের চাষ। গত বছর কৃষি অফিসের পরামর্শ অনুযায়ী এক বিঘা জমিতে চিয়া সিডের চাষ করেছিলেন তিনি। এ বছর তার কাছ থেকে বীজ নিয়ে আরও ১৪ জন কৃষক চাষ করেছেন। আগামীতে চিয়া সিড চাষের জন্য তার নিজ এলাকাসহ আশপাশের জেলার চাষিরাও তার কাছে বীজ চেয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
স্থানীয় কৃষকরা বলেন, আমাদের এলাকার প্রতিবন্ধী কৃষক আক্কাস আলীর মাধ্যমেই নতুন নতুন পদ্ধতিতে চাষ শিখছি। পাশাপাশি নতুন ধরনের ফসলেরও চাষ হচ্ছে। তেমনি চিয়া সিড আমাদের কাছে নতুন একটি চাষ। চিয়া সিড খেলে মানুষের স্বাস্থ্যের উপকার হয়। পাশাপাশি এর চাহিদা ও বাজার দর বেশি হওয়ায় কৃষকরা এটি চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
কৃষক আক্কাস আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত বছর অল্প পরিসরে চিয়া সিড চাষ করি। মাগুরা মসলা গবেষণা কেন্দ্র আমাকে এ বীজ দেয়। এ বছর আমি ছাড়াও আমার এলাকার ১৪ জন চাষি চিয়া সিড করেছে।’
পুষ্টিকর ও দাম ভাল হওয়ায় আগামী বছর একশ’র উপরে চাষি চিয়া সিড চাষ করবেন বলে আশা তার।
মাগুরা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, ‘চিয়া সিড সুপার ফুড হিসেবে খ্যাত। এটির গুণাগুণ ও বাজারমূল্য প্রচুর। যে কারণে আমরা কৃষকদের এটি চাষে উদ্বুদ্ধকরণের পাশাপাশি সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছি।’
৪০ কেজিতে এক মণ হলেও ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের হাট-বাজারগুলোতে এক মণ শসা বিক্রি করতে কৃষককে দিতে হচ্ছে ৪২ কেজি ৩০০ গ্রাম।
এতে কৃষকরা প্রতি কেজি হিসেবে পাঁচ টাকারও কম পাচ্ছে, তবে এ শসা বাজারে কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি করছে পাইকাররা।
অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের জাঁতাকলে পড়ে ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না বলে জানান ক্ষুদ্র কৃষকরা।
কৃষকরা জানান, তারা এ উপজেলায় প্রচুর পরিমাণে শসা আবাদ করেন। এ সুযোগে পাইকারি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তারা কম দামে শসা কিনে বেশি দামে বিক্রি করে নিজেদের পকেট ভারী করেন। এতে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি ক্রেতাদেরও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।
হালুয়াঘাট উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, গত বছর ২৬৫ হেক্টর জমিতে শসার আবাদ হলেও এ বছর ২২৫ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। শসার দাম কম পাওয়ায় অনেক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে শসা চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে প্রতি বছর শসার আবাদ কমার সম্ভবনা রয়েছে।
কৃষকরা জানান, উপজেলার প্রত্যেকটি বাজারে শসার পাইকাররা সিন্ডিকেট করে দাম নিয়ন্ত্রণ করে। তারা যখন যা বলে, সে দামেই বিক্রি করতে হয়। তাদের নির্ধারিত দামে শসা বিক্রি না করলে শসা খেতে পচে নষ্ট হয়। গত বছরও অসাধু পাইকারদের জন্য অনেক কৃষক লাভের মুখ দেখতে না পেরে শসা চাষ ছেড়ে দিয়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে একসময় শসা উৎপাদন একেবারেই কমে যাওয়ারও আশঙ্কা করছেন অনেক কৃষকরা।
ধুরাইল ইউনিয়নের নাগলা বাজার এলাকার কৃষক জাহিদুর রহমান বলেন, ‘২৫ শতাংশ জমিতে শসার আবাদ করেছি। এতে সবমিলিয়ে খরচ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার টাকা। রমজানের শুরুতে ভালো দাম পেলেও দিন যত যাচ্ছে, পাইকাররা দামও কমিয়ে দিচ্ছেন। এখন ২০০ টাকা মণ হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে।’
জুগলী ইউনিয়নের জুগলী এলাকার কৃষক আহম্মদ মিয়া বলেন, ‘৩০ শতাংশ জমিতে শসা চাষ করেছি। এক মণ ৪২ কেজি হিসেবে শসা কিনেন পাইকাররা। আমাদের কাছ থেকে একেবারেই কম দামে কিনে ক্রেতাদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে আমরাও লাভবান হতে পারছি না, ক্রেতারাও প্রতারিত হচ্ছেন।’
পৌর বাজারে শসার পাইকার মনোয়ার হোসেন লিটন বলেন, ‘এ উপজেলার শসা দূরদূরান্তের পাইকাররা ঢাকাসহ ময়মনসিংহের বিভিন্ন বাজারে ট্রাক কিংবা পিকআপ ভর্তি করে নিয়ে আড়তে বিক্রি করেন৷ এরপর ছোট পাইকারসহ খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। সড়কে গাড়ির খরচসহ কয়েকটি হাত ঘুরে ক্রেতা পর্যায়ে দাম বেড়ে যায়। আমাদের উপজেলার বাজারগুলোতে ক্রেতার চাহিদার উপর নির্ভর করে দাম উঠানামা করে।’
শসা ৪২ কেজিতে এক মণ নেয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘অনেক বছর যাবৎ কৃষকদের কাছ থেকে সব পাইকাররা এভাবেই কিনছে। তাই আমিও এভাবেই কিনি।’
শসার দাম সম্পর্কে জানতে সরেজমিনে ময়মনসিংহ শহরতলীর শম্ভুগঞ্জ বাজারে গিয়ে কথা হয় খুচরা শসা বিক্রেতা মোরশেদ মিয়ার সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন আগেও খুচরা ব্যবসায়ীরা ৩০ থেকে ৪০ টাকা হিসেবে শসা বিক্রি করলেও এখন ২০ টাকা কেজি হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। এই বাজারে ময়মনসিংহের চরাঞ্চলের কয়েকটি ইউনিয়নসহ জেলার তারাকান্দা, ফুলপুর ও হালুয়াঘাট থেকেও শসা আসে।
‘পিকআপ ভর্তি করে পাইকাররা নিয়ে এসে আমাদের মতো খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে। তারা আমাদের কাছ থেকে বেশি দামে বিক্রি করায়, আমরাও কয়েক টাকা লাভে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছি।’
হাকিমুল নামের আরেকজন ক্রেতা বলেন, ‘কৃষক আর ক্রেতা সবসময় ঠকে। মূলত সিন্ডিকেট কারণেই এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তর নিয়মিত অভিযান চালালে বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে।’
এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ময়মনসিংহের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুস সালাম বলেন, ‘কৃষকদের কাছ থেকে শসা কিনে নির্দিষ্ট পরিমাণ লাভ করে বিক্রি করতে হবে। অতিরিক্ত দামে কখনোই বিক্রি করা যাবে না। বাজারগুলোতে অভিযান চালানো হবে। সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর প্রমাণ মিললে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
আরও পড়ুন:বীজের বাড়তি দাম, আবাদের মাঝ সময়ে শিষ মরা রোগের সঙ্গে হুইট ব্লাস্টের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন মেহেরপুরের অনেক গমচাষি। কাঙ্ক্ষিত ফসল উৎপাদন নিয়ে তাদের মধ্যে ছিল শঙ্কা, তবে সব শঙ্কা কাটিয়ে গমের বাম্পার ফলন হওয়ার পাশাপাশি বাজার দর ভালো পাওয়ায় হাসি ফুটেছে কৃষকদের মুখে।
জেলায় এ বছর প্রতি হেক্টর জমিতে গম ৪.১ টন উৎপাদন হয়েছে। মণ প্রতি গম বিক্রি করছেন ১ হাজার ৪৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা পযর্ন্ত। গমের মাঠের অধিকাংশ গমের দানাও মোটা তাই কৃষকদের ফলন বেড়েছে।
মেহেরপুর জেলার কৃষি বিভাগ জানায়, চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণ জমিতে গম চাষ হয়েছে, যা আমদানি নির্ভরতা কমাতে ভূমিকা রাখবে। তা ছাড়া অনুকূল আবহাওয়া ও আধুনিক কৃষি প্রযুক্তিতে কৃষকদের আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ায় স্বল্প খরচে সঠিক সময়ে কৃষকরা মাঠ থেকে ফসল তুলতে পেরেছেন। এবার গমের বাম্পার ফলন হয়েছে। তাই আগ্রহ বেড়েছে গম চাষে।
জেলার তিনটি উপজেলা গাংনী, মেহেরপুর সদর ও মুজিবনগর উপজেলার ফসলি মাঠ পরিদর্শন করে দেখা যায়, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ বছর গমের আবাদ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। মাঠ থেকে পাকা গম এখন সোনালি বর্ণ ধারণ করেছে। ফসলের মাঠ থেকে ঘরে তুলতে পাকা গম কেটে মাড়াইয়ের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা।
অধিকাংশ গম ঘরে উঠলেও এখনও মাঠেই রয়েছে অনেক গম। চৈত্রের মাঝামাঝি সময়ে মেঘের চোখ রাঙানি থাকলেও আধুনিক কৃষি পদ্ধতির কারণে গম মাড়াইয়ের কাজ অনেকটা সহজতর হয়েছে।
কৃষি বিভাগের ভাষ্য, চলতি মৌসুমে মেহেরপুরে গম চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। আর আবাদ হয়েছে ১৩ হাজার ৬৫ হেক্টর জমিতে, যেখানে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৩ হাজার ৫৬৬ টন। আর এবার প্রতি হেক্টর জমিতে চার দশমিক এক টন উৎপাদন হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বছর গমের দানা বেশ বড় বড় হয়েছে। গমের বাজার মূল্যও ভালো। মণপ্রতি গম বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪৫০ টাকা থেকে দেড় হাজার টাকা পযর্ন্ত।
জেলার গাংনী উপজেলার নিশিপুর গ্রামের গমচাষি আনোয়ার বলেন, ‘এ বছর এক বিঘা জমিতে আমি গম কেটে মাড়াই শেষে ২০ মণ গম পেয়েছি, যা বিগত কয়েক বছরের মধ্যে রেকর্ড। আর আমার নিজের জমি হওয়ায় সব মিলিয়ে ছয় হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। আর বতর্মানে প্রতি মণ গম বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ টাকা করে।’
আরেক চাষি তহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি দেড় বিঘা জমিতে গম চাষ করেছি। শুরুতে গম ভালো হয়েছিল, মাঝখানে যখন শিষে গমের দানা বাদতে শুরু করে, ঠিক তখনই শিষ মরা রোগ শুরু হয়।
‘ভয় হয়েছিল ভালো ফলন পাব কি না, তবে আল্লাহর রহমতে শেষমেশ ভালো ফলন পেয়েছি। আবার এ বছর গমের দাম বেশ ভালো।’
একই এলাকার গমচাষি ফিরোজ হোসেন বলেন, ‘আমাদের মাঠে এবার ব্যাপক গমের আবাদ হয়েছে। আমি দুই বিঘা জমিতে গম আবাদ করেছি। আজ সপ্তাহখানেক হবে গম কেটে মাড়াই শেষে ফসল ঘরে তুলেছি।’
‘আমার এক বিঘা জমিতে ফলন পেয়েছি ১৭ মণ, আরেকটিতে পেয়েছি ২০ মণ হারে। যেখানে কম ফলন হয়, সেই গমটিতে শিষ মরা রোগ হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম ফলন একেবারে পাব না, তবে আল্লাহ খুব ভালো ফসল দিয়েছেন।’
গম ব্যবসায়ী আনারুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের আড়তে সপ্তাহখানেকের বেশি হবে স্থানীয় গম আসতে শুরু করেছে। এ বছর কৃষকদের গমের ফলন বেশ ভালো। সে হিসাবে আড়তে গমের আমদানি হচ্ছে ভালো। আমরা বতর্মানে আকারভেদে প্রতি মণ গম সংগ্রহ করছি ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা করে।’
আরেক ব্যবসায়ী শিপন বলেন, ‘আমরা প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে গম সংগ্রহ করে থাকি। আজ ১০ দিনের মতো হবে গম সংগ্রহ শুরু করেছি। এবার মাঠের অধিকাংশ গমের দানা বেশ মোটা, যার ফলে কৃষকদের ফলন বেড়েছে। তা ছাড়া গত বছরের চেয়ে এ বছর মাঠে গমের আবাদ বেশি।’
মেহেরপুর জেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ কৃষ্ণকুমার হালদার বলেন, ‘মেহেরপুরে ব্লাস্ট প্রতিরোধী উচ্চফলনশীল গমের জাত বারি-৩৩ ও ডব্লিউএমআইআর গম-৩ নামের দুটি গমের জাত উদ্ভাবনের ফলে এ অঞ্চলে গম চাষে আগ্রহ বেড়েছে কৃষকদের।
‘আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতিতে চাষিদের আগ্রহ বাড়ায় গম চাষাবাদ থেকে মাড়াইয়ের পদ্ধতি অনেক সহজতর হয়েছে। তা ছাড়া গমের বতর্মান বাজারদর ও চাহিদাও বেশ ভালো, যার ফলে চলতি মৌসুমে গম উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে।’
মন্তব্য